দ্বিতীয়তেও অদ্বিতীয় ম্যারাডোনা

কালজয়ী ফুটবলারেরও লম্বা তালিকা আছে। পেলে এবং তাঁকে মুগ্ধ করা অনেক তারকা মাতিয়েছেন ফুটবল মাঠ। লিওনেল মেসিকে ফুটবলের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘ফোরফোরটু’ সর্বকালের সেরার মর্যাদাও দিয়েছে; কিন্তু ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আক্ষরিক অর্থে আজ তাঁর সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ার দ্বিতীয় বার্ষিকী; কিন্তু না থেকেও যেন আরো প্রবলভাবে কাতার বিশ্বকাপে আছেন ম্যারাডোনা, ফুটবলভক্তদের মনজুড়ে। এই উপস্থিতি অমরত্বের স্মারক।

২০১৬ সালে ম্যারাডোনা জীবিত। খেলা ছেড়েছেন বেশ আগে। যতদূর মনে পড়ে, কোচিংয়েও তিনি নেই তখন। তবু বুয়েনস এইরেসে বোকা জুনিয়র্সের প্রবেশপথে বেঞ্চে আসীন ব্রোঞ্জের মূর্তির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিতে ম্যারাডোনা বসে। সেই হাসির অর্থ বহুমুখী। দুই পাশে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা রিকুয়েলমে, তেভেজ, পালের্মোদের অভিভাবক তিনি? নাকি বোকার ফুটবলারকুলের শিরোমণির অহংকার ঠিকরে পড়ছে হাসিতে? তবে সেই বেঞ্চের সামনে-পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা ব্রাজিল, বতসোয়ানা কিংবা বাংলাদেশি পর্যটকের কাছে ম্যারাডোনার ধাতব হাসির মানে একটাই—আমি দেখছি, তোমরা খেলে যাও! বোকার মাঠের একটি বক্স ম্যারাডোনার জন্য বরাদ্দ। যেকোনো টিভি দর্শকই আন্দাজ করতে পারেন, ম্যাচ-ডেতে সেই বক্স কতটা সরগরম করে রাখতেন ম্যারাডোনা।

আরো পড়ুন:
লাউ চাষে ঝুঁকছেন বিরামপুরের কৃষকেরা

মনে পড়ে না ব্রাজিল ম্যাচে গ্যালারিতে পেলের কোনো পোস্টার কিংবা ব্যান্ডানা দেখা গেছে। আর্জেন্টিনার সব ম্যাচে ম্যারাডোনা থাকেন। অবসরে যাওয়ার পর বক্সে, পরলোকের ম্যারাডোনা জায়গা করে নিয়েছেন ২২ নভেম্বরও ভক্তের জার্সিতে, উল্কিতে। আগামীকাল মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচের দিন গ্যালারিতে ম্যারাডোনার ব্যবহৃত একটি জার্সি গায়ে কিংবদন্তিকে স্মরণ করবেন হাভিয়ের মালুফ। ১৯৮০ সালে ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই জার্সি গায়ে খেলেছিলেন ম্যারাডোনা। ফুটবল স্মারক সংগ্রহে খ্যাতনামা মালুফের সংগ্রহে ১৯৭৮ বিশ্বকাপে মারিও কেম্পেসের একটি জার্সিও আছে। তবে ম্যারাডোনার যেকোনো স্মারক তাঁর কাছে অনন্য কারণ, ‘আমরা সবাই তাঁর (ম্যারাডোনা) সম্পর্কে জানি। আমরা জানি, ফুটবল খেলাটার ওপর কী অসীম প্রভাব রেখে গেছেন তিনি।

অবিশ্বাস্য সেই প্রভাব। তিন বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়ার পথে দুর্দান্ত সব ফুটবলারকে পাশে পেয়েছিলেন পেলে; কিন্তু ১৯৮৬ বিশ্বকাপ মানেই ম্যারাডোনা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করেছেন তিনি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ উপহার দিয়ে। নিশ্চিত থাকুন, পদার্থবিদ্যাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ছয় ইংরেজকে কাটিয়ে ম্যারাডোনা যদি দ্বিতীয় গোলটি না করতেন, তাহলে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের মহিমা শেষ হয়ে যেত সেদিনই।

ভিনদেশের কোনো শহরে ম্যারাডোনার মতো প্রভাব আর কোনো ফুটবলার রেখে গেছেন বলেও মনে হয় না। ইতালির ছোট্ট শহর নেপলস ম্যারাডোনা ইস্যুতে চট করে আর্জেন্টিনার কোনো শহরে পরিণত হয়ে যায়! কারণ আছে। ইতিহাসে মাত্র দুটি সিরি এ এবং একটি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছে নাপোলি। তাদের এই তিন সাফল্যেরই কারিগর ম্যারাডোনা। অখ্যাত একটি দলকে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরিয়ে পুরো এস্টাবলিশমেন্টকেই যেন কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। জুভেন্টাস কিংবা দুই মিলানের রাজত্বে নাপোলির অভ্যুত্থান কেউ ভাবেনি, সম্ভবত মেনেও নিতে পারেনি। তাই মিলান কিংবা তুরিনে ম্যাচ থাকলে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতেন ম্যারাডোনা। সেসবের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন অবিশ্বাস্য সব সাফল্যের গল্পে।

রাজনৈতিক বিশ্বাসেও প্রথাবিরোধী ছিলেন ম্যারাডোনা। ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন তাঁর পরম বন্ধু। মেসির শহরের চে গুয়েভারার ভঙ্গিতে চুরুটে টান দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা (ফিফা) কিংবা আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আফা) শাপশাপান্ত করতেন তিনি। পাপারাজ্জিদের লক্ষ্য করে এয়ার গানের গুলি ছুড়তে বুক কাঁপেনি। তবু মিডিয়া তাঁর পিছু ছাড়েনি। ফিফা কিংবা আফা-ও ম্যারাডোনার ইমেজ ব্যবহারের শত চেষ্টা করে গেছে নিয়ত; কিন্তু আপস তাঁর চরিত্রে নেই। ম্যারাডোনার শুধু আপস করেছিলেন ফুটবলের সঙ্গে। তাঁর সবটাজুড়ে ছিল ফুটবল। আর ফুটবলের অন্তরজুড়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ছিলেন, আছেন এবং থাকবেনও।

ডিসেম্বর ২৫.২০২১ at ১৬:২৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/এসআর