ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দিবস সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়েই ৪৩ বছর পার

স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। কুষ্টিয়া থেকে ২২ ও ঝিনাইদহ থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর নামক স্থানে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ ৪৪ বছরে পা রাখলো। দীর্ঘ ৪৩ বছরের পথ চলায় নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বগৌরবে উচ্চশিক্ষার প্রদীপ্ত মশাল জ্বালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইসলামিক ও আধুনিকতার সমন্বয়ে পরিচালিত এটি এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যা দেশের প্রতিটি প্রান্তে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করছে।

আরো পড়ুন:
ঝিনাইদহ পৌরসভার চেক জালিয়াতিতে সাবেক পৌর নির্বাহী ও হিসাবরক্ষক বরখাস্ত

শুরু থেকে বর্তমান :

১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাই এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গাজীপুর বোর্ড বাজারে এবং ১৯৯০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অপর এক আদেশে কুষ্টিয়া শহরে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে দুটি অনুষদের অধীন চারটি বিভাগে আটজন শিক্ষক ও তিনশ ছাত্র ভর্তির মাধ্যমে শুরু হয় একাডেমিক কার্যক্রম। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরের সবুজ চত্বরে মাটির সড়ক আর সবুজ গাছপালার মধ্যে গড়ে ওঠে দুটি ভবন। ভবন দুটি নিয়েই শুরু হয় মূল ক্যাম্পাসের কার্যক্রম। বর্তমানে ৮টি অনুষদের অধীন ৩৬টি বিভাগে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন।

অন্যান্য অনুষদে বিভাগ বৃদ্ধি পেলেও ধর্মতত্ত্ব অনুষদে প্রতিষ্ঠাকালীন তিন বিভাগই রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন ৪০৩ জন, কর্মকর্তা ৪৯৪, সহায়ক কর্মচারী ১৩২, সাধারণ কর্মচারী ১৫৮, এমফিল গবেষক ২১৯ এবং ২৯০ জন পিএইচডি গবেষক রয়েছেন। এছাড়া এখানে ১টি ইন্সটিটিউট ও ১টি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম উপাচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম এবং উপ-উপাচার্য হিসেবে ইবির আইসিটি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান এবং কোষাধ্যক্ষ পদে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন ভুঁইয়া নিষ্ঠার সাথে দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

ক্যাম্পাস যেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য :

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শের স্বারক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ একরের প্রতি ইঞ্চিতে দৃশ্যমান। এ লক্ষ্যে প্রধান ফটকের সন্নিকটে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’ ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু হল ফটকের সামনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ‘মুক্তির আহ্বান’ ও ‘শাশ্বত মুজিব’ উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া প্রধান ফটকের উত্তরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’, দক্ষিণে শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ বিদ্যমান। কেন্দ্রীয় মিলনায়তনের নাম ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তন’ করা হয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্চতর গবেষণার্থে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর হিসেবে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রয়াত শামসুজ্জামান খানকে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ পদটি খালি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নার এবং একুশে কর্নার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র :

৫৩৭ কোটি ৭ লাখ টাকার মেগা প্রকল্পের আওতায় নয়টি দশ তলা ভবনের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে। নির্মাণাধীন ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে দুটি ছাত্র ও দুটি ছাত্রী হল, একটি একাডেমিক ভবন, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য একটি, কর্মচারীদের জন্য একটি, নির্মাণাধীন শেখ রাসেল হলের দ্বিতীয় ব্লক এবং নতুন প্রশাসন ভবন নির্মাণ। দশতলা বিশিষ্ট আবাসিক হলগুলো নির্মাণ শেষ হলে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত হবে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের সংকট দূর হবে এবং নতুন নতুন বিভাগ খোলার সুযোগ সৃষ্টি হবে একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলে। প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টির মধ্যে ৫টি ভবনের উর্দ্ধমুখী সম্প্রসারণের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

ক্রীড়াঙ্গনে এগিয়ে ইবি :

ক্রীড়াক্ষেত্রে ইবির রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ভারোত্তোলন, ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট ও অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ইসরাত জাহান ইভা দুইবার দেশের দ্রততম মানবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল প্রতিযোগিতায় এ বিশ্ববিদ্যালয় নয়বার, ফুটবলে তিনবার ও অ্যাথলেটিকসে চারবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। এছাড়াও ভলিবলে তিনবার রানার্স আপ এবং ক্রিকেটে তিনবার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পসের তৃতীয় আসরের হ্যান্ডবল ফাইনালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এবং বাস্কেটবল ইভেন্টে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে পরাজিত করে ইবি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

আবাসন সঙ্কট :

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থায় রয়েছে ৮টি হল। এর মধ্যে ৫টি ছাত্রদের এবং ৩টি ছাত্রীদের। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। বর্তমানে ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক হলে অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন।এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও মেসে থাকছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। আর সিংহভাগ শিক্ষার্থী কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ শহরে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষক-কর্মকর্তাদেরও ক্যাম্পাসে আবাসন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত।

পরিবহন সঙ্কটে শিক্ষার্থীরা :

শহরে অবস্থানকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যাতায়াতের জন্য একমাত্র পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলে ডাবল ডেকার ১ টি, বড় বাস ১৩টি, এসি কোস্টার ৭টি, ৫ টি মিনিবাস ও ২টি এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিবহন না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাড়ায় চালিত পরিবহনের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের প্রায় ৮ শতাংশ পরিবহন খাতে ব্যয় হলেও প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরেও পরিবহন ভোগান্তি কাটেনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। পরিবহন সমস্যার স্থায়ী সমাধান ও অদক্ষ চালক দ্বারা গাড়ি চালানো এবং মেয়াদোত্তীর্ণ বাসসমূহে শিক্ষার্থী পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সেশনজট রয়েই গেল :

৪৪ বছরে দাঁড়িয়েও সেশনজটের কবল থেকে মুক্ত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২৫টি বিভাগের মধ্যে ১৩টি বিভাগের ফলাফল প্রকাশ, চূড়ান্ত পরীক্ষা সম্পন্ন কিংবা চলমান থাকলেও বাকি ১২ বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা তো দূরের কথা এখনও ক্লাসই সম্পন্ন হয়নি। আবার কোন কোন বিভাগে ক্লাসই শুরু হয়নি।নাম না প্রকাশের শর্তে পরিসংখ্যান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রায় ৬ মাস আগেই আল-কুরআন বিভাগ শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। এছাড়া অনেক বিভাগ চূড়ান্ত পরীক্ষা সম্পন্ন করে রেজাল্ট প্রসেসিংয়ে ব্যস্ত আছেন। অথচ আমরা পিছিয়েই থাকলাম, ক্লাসই শুরু হয়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি রোডম্যাপে এসে সেশনজট নিরসনে কাজ করার দাবি জানাচ্ছি।

মাত্র চারবার সমাবর্তন :

৪১ বছরের ইতিহাসে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র চারবার। নিয়মিত সমাবর্তন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত ডিগ্রির সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে নেয়ার সুযোগও হচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থীর।

নানা অপ্রাপ্তির ঢেঁকুর :

প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছরেও শিক্ষার্থীদের অপ্রাপ্তির শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে তারা তুলে ধরেছেন নানা অপ্রাপ্তির কথা। চলমান শিক্ষাবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধিকরণ, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, মেধাবী ও অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তির আওতায় আনা, অনতিবিলম্বে প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইল প্রদানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ, শিক্ষাত্তোর সার্টিফিকেট উত্তোলন পদ্ধতি সহজ ও আধুনিকায়ন করা, ছাত্র-শিক্ষক নোংরা রাজনীতির নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চাকরণ, ইকসু গঠন ও নির্বাচন দিতে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া ও হলের ডাইনিং গুলোতে খাবার ও পরিবেশের মান বৃদ্ধিকরণ।

শিক্ষার্থীদের ব্যবহার্য প্রত্যেক ভবনের টয়লেট সংস্করণ, সকল ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা ও ধর্মীয় কার্যাদি পালনের জন্য আলাদা আলাদা উপাসনালয় নির্মাণ, সকল প্রকার বর্ধিত ফি প্রত্যাহার করাসহ বিভিন্ন দাবি জানান তারা। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, প্রতিষ্ঠার অনেক বছর পার হলেও বিভিন্ন সমস্যা রয়েই গেছে। আমরা সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে মনোনিবেশ করবেন বলে আশা রাখি।

ডিসেম্বর ২২.২০২১ at ১০:৩৬:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/এসআর