এশিয়ার নোবেল ব্যামন ম্যাগসেস পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজসেবিকা “অ্যাঞ্জেলা” কালীগঞ্জের সন্তান

বাংলাদেশের আলোকিত নারী অ্যাঞ্জেলা গমেজ ১৯৫২ সালের ১৬ জুলাই গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার নাগরী ইউনিয়নের নিভৃত মাল্লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আগস্টিন গমেজ, মায়ের নাম ইসাবেলা। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। রোমান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী আঞ্জেলার পূর্বপুরুষ ভক্তগোষ্ঠী বা সাধু ভক্ত। অ্যাঞ্জেলা গমেজ পৈত্রিক ও জন্মসূত্রে যশোরের মানুষ না হলেও বর্তমানে যশোর তার স্থায়ী ঠিকানা। প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল তিনি যশোরে বসবাস করছেন।

আরো পড়ুন:
চৌগাছায় সাহিত্য আলোচনা ও কবিতা পাঠের আসর

ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আঞ্জেলা গমেজের নাম রাখা হয় ফুল। শিশু বয়সে ফুলকুমারী বলেই সকলের কাছে আদরের ছিলেন। পরবর্তীতে তার নাম রাখা হয় ফেলিসিতা (আনন্দ দানকারী)। আর ভাল নাম রাখা হয় আঞ্জেলা (স্বর্গীয় দূত)। আঞ্জেলার শিক্ষার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। পরে মঠবাড়ি মিশন স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১১/১২ বছর বয়সে আঞ্জেলা পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হলে তার অভিবাবকরা তাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এসময় তিনি ফাদার বার্কম্যানের সাহায্য পান। ফাদার মঠবাড়ি মিশন স্কুলে শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব দেন আঞ্জেলাকে। ১২ বছর বয়সে তার নিজের স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ফাদারের শরণাপন্ন হন। গ্রাম থেকে ৭/৮ কিঃমিঃ দূর নাগরী মিশনের পানজোড়া বোর্ডিং স্কুলে ফাদারের সহযোগিতায় আঞ্জেলা ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন।

এই স্কুলে আঞ্জেলা এক বছর পড়েন এবং ক্লাস সিক্সে প্রথম গেডে বৃত্তি পান। ফাদারের সহযোগিতায় আঞ্জেলা ঢাকা হলিক্রস কলেজের টিচার্স ট্রেনিং-এর সর্ট কোর্সে ভর্তি হন। প্রশিক্ষণ শেষে গ্রামে ফিরে যান এবং মঠবাড়ি মিশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু শিক্ষালাভের প্রবল আগ্রহের কারণে আঞ্জেলা কুষ্টিয়ার ভবেরপাড়া মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ভবেরপাড়া মিশনের প্রধান মাদার পিরিনা যশোরে বদলী হলে আঞ্জেলা যশোরে চলে আসেন এবং সেক্রেড হার্ট স্কুলে ভর্তি হন।

এরপর আঞ্জেলাকে মাদার সেক্রেড হার্ট স্কুলের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দিনে শিক্ষকতা আর রাতে লুকিয়ে মোম জ্বালিয়ে লেখাপড়া অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৮ সালে যশোর শহরের সেবাসঙ্ঘ স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এস.এস.সি পাশ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি যশোর মহিলা কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এইচ.এস.সি পাশ করেন। ১৯৭৪ সালে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তিনি যশোর মহিলা কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি যশোর সেক্রেড হার্ট স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

স্নাতক পাশ করার পর আঞ্জেলা গমেজ গ্রামের অসহায় নির্যাতিত মহিলাদের মধ্যে তার ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করেন। ১৯৭৬/৭৭ সালে আঞ্জেলা সাতক্ষীরার ইটালীর নাগরিক এনসো ও লাউড়ার কাছে এক মাসের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ নেন । ১৯৭৮ সালে আঞ্জেলা গমেজ হস্তশিল্পের কাজ শেখার জন্য রাজশাহী যান এবং সেরিকালচারের উপর একমাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারপর তিনি নারকেল মালার গহনা ও হস্তশিল্পের কাজ শেখার জন্য বরিশালের গৌরনদী যান। সেখান থেকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং অন্য মহিলাদের শিখিয়ে আঞ্জেলা একটি নারীদল গড়ে তোলেন।

১৯৮০ সালে আঞ্জেলা কানাডার নাগরিক প্যাটসিত্রান এর সহযোগিতা পান। ১৯৮১ সালে আঞ্জেলা হস্তশিল্পের কাজের পরিধি বৃদ্ধির জন্য ১৮ জন মহিলাকে নিয়ে ঢাকায় যান। তিনি মহিলাদের উন্নত সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে যশোর ফিরে আসেন। ১৯৮১ সালে বিসিক মেলায় স্টল দিয়ে আঞ্জেলা সেলাই কাজের জন্য স্বর্ণপদক অর্জন করেন। এসময় কুসুমদিনি, আড়ং থেকে সেলাই কাজের অর্ডার পান। ১৯৮১ সালে আঞ্জেলা গমেজ তার স্বপ্নের সংগঠন “বাঁচতে শেখা”র কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে আরবপুর এলাকায় ১৭ বিঘা জমিসহ একটি পরিত্যক্ত ভবন কম মূল্যে কিস্তিতে কিনে নেন। ১৯৯২ সালে নরওয়ে এম্বাসির আর্থিক সহায়তায় বাঁচতে শেখার প্রধান কার্যালয় নির্মাণ করা হয়। অফিস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, ক্লাসরুম, ১০০ জন প্রশিক্ষণার্থীর থাকার ঘর, লাইব্রেরী গড়ে তোলা হয়।

নিপীড়িত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া নারীকে উন্নয়নের অভিযাত্রায় সামিল করার কঠিনতম প্রচেষ্ঠায় অকুতোভয়, নিবেদিতপ্রাণ, সাহসী, লক্ষ্যে পৌছানোর ব্যাপারে স্থিরচিত্ত, নিঃস্বার্থ, অতীব সাধারণ জীবন-যাপন করা সত্ত্বেও যিনি অসাধারণ, সুদীর্ঘ ৩৭ বছর যাবত নিজেকে সমর্পন করেছেন নারীর জন্য সৌহার্দ্যপুর্ণ, সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠায় তার নাম আঞ্জেলা গমেজ। ৩৭ বছর পূর্বে একেবারেই একটি পিছিয়ে পড়া কুসংস্কারের যাতাকলে পিষ্ট প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কাজ শুরু করে শত বাধা-বিঘ, বিপদ, কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে তিনি বাঁচতে শেখার কাজকে গ্রাম থেকে ইউনিয়নে, ইউনিয়ন থেকে উপজেলায়, উপজেলা থেকে জেলায় জেলায় বিস্তৃত করেছেন। এ ৩৭ বছরে বাঁচতে শেখা শত শত প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে লাখো লাখো নারী, শিশু তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির কল্যাণে কাজ করে চলছে। বর্তমানে বাঁচতে শেখা ১৮টি জেলার ৫০টি উপজেলায়, দু’টি বিভাগে ২০টি বিভিন্ন কল্যাণমুখী প্রকল্প পরিচলনা করছে । এ প্রকল্পগুলো থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক উপকৃত হচ্ছে।

আঞ্জেলা গমেজ তার সৃষ্টি বাঁচতে শেখার মাধ্যমে অধিকার বঞ্চিত পিছিয়ে পড়া নারীর ক্ষমতায়নে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের নিশ্চয়তা প্রদানে সার্বিকভাবে বিভিন্ন বলিষ্ঠ প্রক্রিয়ায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অকৃত্রিম ভালবাসায়। আঞ্জেলা গমেজ তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বাঁচতে শেখার মাদ্যমে গ্রামীণ অসহায়, নির্যাতিত গরীব মহিলাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছেন। তিনি মূলতঃ স্বামী পরিত্যাক্তা, বিধবা, ধর্সিত ও নির্যাতিত নারীদের জন্য কাজ করছেন। অসহায় নারীদের সামাজিক অপবাদ, অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি তার সংগঠন বাঁচতে শেখার পক্ষ থেকে স্বাবলম্বী করে বাঁচতে শিখিয়েছেন। তিনি পোড় খাওয়া নারীদের সংগঠিত করে হস্তশিল্প, পশুপালন, মৎস্যচাষ, বৃক্ষরোপণের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করেছেন।

ডিসেম্বর ১8.২০২১ at ১০:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/এসআর