যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিলেটে আ.ফ.ম কামাল হত্যাকান্ড ঘটে

সিলেট জেলা বিএনপি’র সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক আ.ফ.ম কামাল হত্যাকান্ডের আগে যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে জটিলতা তৈরী হয়, সেই বিষয় গুলোর খুঁটিনাটি বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সিলেট নগরীর আম্বরখানার মন্নান সুপার মার্কেটের নীচ তলায় লাহিন এয়ার সার্ভিসের মালিক জইন উদ্দিন মেম্বারের কাছে বিগত বছর খানেক আগে সুনামগঞ্জের এক ব্যক্তি সৌদি আরব কাজের ভিসায় যেতে ইচ্ছুক হওয়ায় জইন মেম্বার তার লাহিন ট্রেভেলসের মাধ্যমে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে কাজের ভিসা ছাড়া সৌদি আরব পাঠান। ঐ ব্যক্তি সৌদি আরব গিয়ে কাজ না পাওয়ায় তার গ্রামের বাড়ীতে ফোন দিয়ে বিষয় গুলো জানান। গ্রামের লোকজন লাহিন এয়ার সার্ভিসের জইন মেম্বারের কাছে এই পরিস্থিতি জানিয়ে টাকা ফেরত চান।

আরো পড়ুন:
দৌলতপুরে সাজেদা ফাউন্ডেশনের অবহিতকরণ সভা

এ নিয়ে জইন মেম্বারের সাথে দেন-দরবার করলে লাহিন ট্রেভেলস থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়ায় প্রবাসী পক্ষকে আম্বরখানার এক অজ্ঞাত লোক সৌদি প্রবাসী পরিবার পক্ষকে আল মারজান রেস্টুরেন্টের গলির ভিতর সম্রাট গংদের হায়ার করতে বলেন। এতে সম্রাট গং লাহিন ট্রাভেলস-এ গিয়ে চাঁদাবাজী, খুন, গুমের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের জিম্মি রেখেছিল। তবে দুবাইতে কর্মরত সৌদি প্রবাসীর আপন স্বজন মিজান নামক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান যে, লাহিন ট্রেভেলস যাকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিল, তিনি তার আপনজন হন। সৌদি আরব আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাকে সেখান থেকে ওমানে কাজের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে ঘটনার মোড় ঘুরাতে লাহিন ট্রেভেলস এর জইন মেম্বার মামলার গতিপথ পরিবর্তন করতে আ.ফ.ম কামালের ভাইকে কামাল হত্যার মামলায় প্রভাবিত করে সৌদি প্রবাসী পক্ষকে আসামী করার ষড়যন্ত্র করছেন বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে। এদিকে সম্রাট গংদের অপরাধ কর্মকান্ড সম্পর্কে জইন মেম্বারের পাশের বাড়ীর আপন স্বজন আ.ফ.ম কামালকে জানালে কামাল তার দলীয় বন্ধুদের নিয়ে গত ১৯ শে অক্টোবর লাহিন এয়ার সার্ভিসে গিয়ে সম্রাট গংদের মুখোমুখি হন। এতে উভয় পক্ষে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সম্রাট সহ তার সহযোগিরা মন্নান সুপার মার্কেটের দু’তলায় দৌড়ে উঠলে চমন ও কামাল তারা দু’জনের একজনের হাতে সম্রাট ছুরিকাঘাতে আহত হয়। পরে সম্রাট চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়। লাহিন ট্রেভেলসে সৌদি প্রবাসী ঐ ব্যক্তির পক্ষের লোকজন ১৯ অক্টোবরের আগে থেকে দফায় দফায় দেন-দরবার, তর্কাতর্কি চলছিল।

কোতোয়ালী থানাধীন আম্বরখানার আল মারজান রেস্টুরেন্ট গলিতে ছাত্রলীগ নামধারী সম্রাট, টাক পড়া তারেক আহমদ রাজু, শাকিল, রনি, রুবেল, সাদেক, আল আমিন গং বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আম্বরখানা বাজারের একটি অংশে স্বঘোষিত পুলিশের ফুটপাত লাইনম্যান আল আমিন ও সাদেকের সঙ্গে সম্রাট গ্যাংদের পরিচয় সূত্রে তারা একই গ্যাংকে যুক্ত হয়। তাদের লাইনম্যান দুজনকে আম্বরখানা বাজারের সকলে পুলিশের লাইনম্যান হিসেবে চিনে। আল আমিন ও সাদেক তারা আম্বরখানা থেকে প্রতিদিন ফুটপাত ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধ চাঁদা তুলার সময় সম্রাট গ্যাং জড়িয়ে পড়ত।

কোতোয়ালী থানাধীন শাহজালাল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র ফাঁড়ী এই বিষয় গুলো জানত। আল আমিন ও সাদেকের সহযোগিতায় হোটেল টি ল্যান্ডের ভিতর দীর্ঘদিন জুয়া, মাদকের আসর নিয়মিত জমত। কখনো রুমের ভিতর, কখনো হোটেলের ছাদের উপর এ আসর গুলো চলতে থাকে। আল আমিন, হোটেল টি ল্যান্ডের মালিক হোসাইন আহমদ, সম্রাট , রাজু, শাকিল ও রনিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এই মাদক ও জুয়ার আসর। পাশাপাশি সেখানে ছোট ও মাঝারী অস্ত্রের ব্যবসা হতো বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। হোসাইন আহমদ বহুদিন আগে আগ্নেয়াস্ত্র সহ একটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটে বের হয় বলে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে।

গত ১০ই এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টার দিকে একজন সাংবাদিককে সম্রাট গ্যাং অপহরণের মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করে। ঐ সাংবাদিক তাদের সাথে সাহসের জোরে বেঁচে গিয়ে কোতোয়ালী থানায় সম্রাট গ্যাংদের বিরুদ্ধে একটি হত্যার চেষ্টা মামলা দায়েরের আবেদন করলে মামলাটি দেড় মাসেও রেকর্ড না হওয়ায় এসএমপি পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে মামলাটি রেকর্ড হয়। ঐ মামলা এবং ঘটনার আসল বিষয় গুলো জানতে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা শাখা থেকে এসএমপি পুলিশকে তলব করা হয়। সেই মতে কোতোয়ালী থানা পুলিশ কর্তৃপক্ষ মামলা রেকর্ড করে স্বরাষ্ট মন্ত্রালয়ের জন নিরাপত্তা শাখায় ফিরতি প্রতিবেদন প্রেরণ করে। এই ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় মামলা নং- ৭১, জিআর নং- ৪৮৬, তারিখ: ২৮/০৬/২০২২ ইং।

ঐ মামলায় বর্তমানে সম্রাট গ্যাংদের অনেকে জামিনে আছে এবং অনেকেই পলাতক রয়েছে। গত ১৯ শে অক্টোবর আম্বরখানায় সম্রাট গ্যাং ছুরিকাঘাতে আহত হওয়ার পরে কোতোয়ালী থানায় আ.ফ.ম কামাল গংদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করলে মামলাটি সাথে সাথে রেকর্ড হয়। ঐ মামলার ৯ নাম্বার আসামী যিনি, তিনি আমেরিকায় বসবাস করেন। ওই প্রবাসীর আত্মীয় আম্বরখানায় মোবাইল শো’রুমের ব্যবসা করতেন। তিনি সম্রাট গ্যাংদের চাঁদা না দেয়ার বিরোধের কারণে ওই ব্যবসায়ীর আপন আত্মীয়কে সম্রাট তার মামলায় ৯ নাম্বার আসামী বানিয়ে দেয়। আম্বরখানার হোটেল টি ল্যান্ডে দীর্ঘদিন ধরে মাদক, জুয়া ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা হলেও সেক্ষেত্রে পুলিশ ছিল নীরব। মাঝে মধ্যে যুবলীগের এক নেতা তা সহ্য করতে না পেরে হোটেল টি ল্যান্ডে তাদের আসরে হানা দিয়ে প্রতিবাদ করতেন। সম্রাট গ্যাং আম্বরখানা এলাকার মনিপুরী পাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত।

তার এই গ্যাংকে তারেক আহমদ রাজু, রনি, লাইনম্যান সাদেক, লাইনম্যান আল আমিন, জালালাবাদ আবাসিক এলাকার রুবেল, শাহজালাল দরগা পুকুর পাড়ের তামিম, মৃদুল, শাকিল গ্যাং নিয়মিত হোটেল আল মারজান গলিতে গ্যাং পরিচালনা করত। আম্বরখানায় টোকাই গ্রুপ হিসেবে লোকজন তাদেরকে চিনে। ৫/৬ বছর আগে আম্বরখানার সাবেক গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ারের সাবেক এক কর্মকর্তা ও বাম রাজনীতির ছাত্র নেতা ঐ গলিতে রাতের বেলা একদিন তাদের হাতে অপহরণের শিকার হন। পরে তার ভাই ঘটনা জানতে পেরে ডিআইজি’র কাছে ফোন দিলে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। ঐ ছাত্র নেতা এখন কানাডায় আছেন।

প্রায় ৭/৮ মাস আগে সিলেট সদরের আমেরিকা প্রবাসী পরিবারের সাদমান নামের এক যুবককে তারা ধরে এনে ঐ গলিতে অপহরণ করে নির্যাতন চালায়। ঘটনাটি ছিল রাতের বেলায়। সম্রাট, রাজু, শাকিল গংরাসাদমানের মোবাইল ফোন নাম্বারের মাধ্যমে তার বাসায় ফোন দিয়ে বলে, মুক্তিপণ হিসেবে ৫ লক্ষ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। যারা লুকিয়ে লুকিয়ে সে ঘটনা দেখেছে তাদের সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এসব বিষয় উঠে আসে। গলির ভিতর সম্রাট গ্যাং যারাই বিভিন্ন ধরনের বড় বড় ঘটনা ঘটাতো তারা সকলেই ছাত্রলীগ নামধারী হিসেবে আম্বরখানায় প্রভাব বিস্তার করত। ব্যবসায়ীরা থাকতেন সব সময় আতংকিত। তাদের এই ঘটনায় ব্যবসায়ীরা অতিষ্ট হয়ে সরকারকে ভুল বুঝতে শুরু করে।

সম্রাট গ্যাংয়ের এমন অবস্থা সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতার কাছে নালিশ গেলে তারা নির্যাতিতদের পরামর্শ দিয়ে বলতেন, থানায় গিয়ে মামলা করো। কিন্তু এসএমপি’র থানায় গিয়ে যখন মামলা হয়, তখন সম্রাট গ্যাংদের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড হওয়া দূরে থাকে। যেদিন সম্রাট ছুরিকাঘাতে আহত হয়, ঐদিন সিলেট নগরীর তিনটি গ্রুপ স্বসস্ত্র অবস্থায় মোটর সাইকেল যোগে সজ্জিত হয়ে আম্বরখানা এলাকায় শোডাউন করে। এসময় সম্রাট গ্যাংদের সহযোগি লাইনম্যান সাদেক ও তারেক আহমদ রাজু আম্বরখানার ব্যবসায়ীদের হুমকি দেয়, ঘন্টাখানেকের মতো বিভিন্ন মার্কেটের দোকানপাট বন্ধ রাখায়। সাথে সাথে এই ঘটনার খবর যায় বাজার কমিটির সেক্রেটারীর কাছে।

তিনি ঘটনাস্থলে পৌছে সাদেকের কাছে প্রতিবাদ জানান এবং ব্যবসায়ীদের বলেন, বাজার কমিটি বা সরকার আপনাদের দোকান বন্ধ রাখায়নি। এখন থেকে আপনারা হাতে লাঠি নিয়ে দোকানদারী করবেন। এসময় মোটর সাইকেল শোডাউনকারীরা আম্বরখানা থেকে সোজা খাসদবীর এলাকায় পৌছে ছাত্রদল নেতা চমনের দোকানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। আম্বরখানায় শোডাউনকালে সম্রাটের সহযোগি সাদেক জোর গলায় উপস্থিত পুলিশের একটি টিমের নেতৃত্বে এএসআই রহিমকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমরা এখানে থাকতে সম্রাটেকে কেন ছুরিকাঘাত করা হল? এর প্রেক্ষিতে পুলিশ টিমের একজন সাদেককে লাঠিপেটা দেয়।

এর কয়েকদিন আগে অপর পুলিশের লাইনম্যান নামে পরিচিত আল আমিন, সম্রাটের পক্ষ নিয়ে পুলিশের সাথে তর্কাতর্কির সময় আল আমিনও পুলিশের হাতের লাঠিপেটা খায়। শাহজালাল তদন্ত কেন্দ্র ফাঁড়ীর ইনচার্জ এসআই কাজী জামান গত ১০ এপ্রিল ঐ ফাঁড়ীর দায়িত্ব গ্রহণ করে সম্রাটে গংদের বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড সম্পর্কে তাকে জানানো হলেও তাদের একজনকেও তিনি চোখের সামনে পেলেও ধরেননি। সম্রাটের অন্যতম সহযোগি শাকিলের বাড়ী বরিশালে হলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামে অসংখ্য খুন-খারাপী, ছিনতাই কর্মকান্ডে জড়িত ছিল।

তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও সিলেট সহ কয়েকটি এলাকায় মামলা রয়েছে। গত ৬ নভেম্বর আ.ফ.ম কামাল হত্যাকান্ডের পর ঘটনাস্থলে পরেরদিন একটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যায়। তারা সেখানে ম্যাপ সহ ঘটনাস্থল চিহ্নিত করে তদন্তের কাজ চালায়। তদন্তকারী একজন কর্মকর্তার নোটে আম্বরখানার আল মারজান গলির সম্রাটেগ্যাংদের উল্লেখিত কয়েকজনের নাম আলোচনাকালে উঠে আসে।

ডিসেম্বর ১৫.২০২১ at ১০:০৪:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএমডি/এসআর