নীল রঙা বাসে বিচিত্র বর্ণিল বসবাস

ক্লাস শেষে বাস ছাড়বে, দুই মিনিট থাকতেই তড়িঘড়ি করে দৌড়। ‘মামা দুই মিনিট দাঁড়ান’- এ যেন নিত্যদিনের কথা। বলছিলাম প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের চালকদের এমন রোজকারের কথোপকথন।কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে প্রায় ১৬ বছর ক্যাম্পাস থেকে কুমিল্লা শহর আবার শহর থেকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে নীল বাসগুলো।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের প্রথম স্মৃতি হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল বাস। ঝড়বৃষ্টি ভেজা পথই হোক আর তীব্র গরমে সিদ্ধ দিনই হোক ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিবে ভালোবাসার নীল বাস। ক্লাস-পরীক্ষা কিংবা প্রেজেন্টেশন যাই হোক না কেন এক ঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেয় ভালবাসার এই নীল বাস । প্রতিদিন সকালে শিক্ষার্থীরা পুলিশ লাইন, কান্দির পাড়, টমছম ব্রিজ আর পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।

আর ক্যাম্পাসের গোল চত্বরে বাস থেকে নেমে কেউ যায় ক্লাসে কেউবা আড্ডায় মেতে ওঠতে চলে যায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন চত্তরে। শিক্ষার্থীদের আসা-যাওয়ার নিত্যসঙ্গী প্রিয় এই নীল বাস। শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে আনা-নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বাসের পাশাপাশি বিআরটিসির ভাড়া বাসেরও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন সকালে এসব বাসে ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে-বসে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে পাশে আর কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে প্রতিদিন সকালে এসে পাড়ি জমায় নীল ও লাল বাসের সারি।

তবে প্রতিটি নীল বাসের রয়েছে আলাদা নাম, আলাদা পরিচয়! নীলকাব্য, নীলাচল, কৃষ্ণচূড়া, কাশফুল আরও কত কি! মজার ব্যাপার হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ নয়, শিক্ষার্থীরাই এই সব নাম দিয়ে বাসকে চিহ্নিত করে। নিজেরাই বাসে লাগায় স্টিকার আর সাইনবোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল বাসকে ঘিরে ছাত্রছাত্রীদের জীবনে প্রতিদিনই রচিত হয় আনন্দ-বেদনার কত কাব্য। বাসে সিট রাখা নিয়ে হাতাহাতি-মারামারি প্রাত্যহিক ঘটনা। নিজেদের মধ্যে এই ঝগড়াঝাঁটি মিটমাট করে নেয়াও সাধারণ ঘটনা।

বাসে আসা-যাওয়া করতে করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠার ঘটনাও বিরল কিছু নয়। শিক্ষাজীবন শেষে যৌথ জীবনের দিকেও পা বাড়ান অনেক জুটি। এক বুক স্বপ্ন, রোমাঞ্চ আর উদ্দীপনা নিয়ে প্রথম বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় পা রাখে শিক্ষার্থীরা।

ফেসবুকেও রয়েছে বাসের সক্রিয় কমিটি। কোন কারণে বাসের সময়সূচী পরিবর্তন করা হলে ফেসবুক গ্রুপ কিংবা পেজে তা জানিয়ে দেয়া হয়। বাস কমিটির সদস্য কিংবা শিক্ষার্থীরা এ দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছেন নিজেদের স্বার্থেই। বাসের সময়সূচীতে পরিবর্তন জানানো থেকে শুরু করে প্রতিটি কমিটির আয়োজনে বার্ষিক বনভোজন, নবীনবরণ, ইফতার পার্টি এমনকি বাসের কোন শিক্ষার্থীর জন্য রক্ত বা অর্থ সাহায্যের প্রয়োজনেও সর্বদা সক্রিয় এই বাসে যাতায়াত করা শিক্ষার্থীরা। এসব কমিটি পরিবারের মতো, যে পরিবার শক্ত বাঁধনে বেঁধে রেখেছে যাত্রীদের সবাইকে।

বাসের শিক্ষার্থী খন্দকার রেদোয়ান তানজিম বলেন, বাসে উঠারও যে এক অন্যরকম অনুভূতি হতে পারে সেটা বুঝতে পারলাম যেদিন প্রথম ভার্সিটির এই নীল বাসে উঠি, এই বাসটা বাস্তবে শুধুই একটা বাহন হতে পারে কিন্তু আমার কাছে আশা উৎসাহ আর অনুভূতির বাহন’। অন্য এক জন শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা রিমা বলেন, ‘গণপরিবহনে উঠলে নিরাপত্তার ভয় থাকে, অনেক সময় হ্যারেজমেন্টের ও শিকার হতে হয় তবে ভার্সিটির বাসে সবসময় নিরাপদ মনে হয়। এই বাস আমার স্বপ্নের অনুপ্রেরণা যোগায়।

দিন শেষে প্রিয় এই নীল বাসটি হয়ত আড়ম্বরপূর্ণ কিছুই নয়, এতে নেই এসি, নেই ভাল আসনও, সবার জন্য নির্ধারিত জায়গাও নেই, অনেক সময় হয়ত দাঁড়িয়ে কিংবা ঝুলে যেতে হয়। তারপরও অনেকে স্বপ্ন বুনতে থাকে এই বাসের কোলে বসে। নীল বাসের জন্য আবেগ ভালোবাসা একটু বেশি হয়।

নভেম্বর ১২,২০২২ at ১৪:১৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ/এসআর