দৌলতপুরে প্রধানমন্ত্রীর ঘর নেয়ার মানুষ এখন নেই!

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ওমরপুর এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর। ছবি: দেশ দর্পণ

মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সারাদেশে ধাপে ধাপে গৃহহীনদের মাঝে জমিসহ ঘর উপহার দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২০ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেয়া শুরু হয়। যা এখনো চলমান রয়েছে। শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। এর ধারাবাহিকতায় দেশের অন্যান্য স্থানের মতো কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়ও ভূমিহীন, গৃহহীনদের প্রধানমন্ত্রীর ঘর দেয়ার কার্যক্রম চলছে। তবে এ উপজেলায় এখন আর প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নেয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কিছুসংখ্যক মানুষ ঘর নিতে চাইলেও নিজেদের সুবিধাজনক স্থানে না হওয়ায় তারা অনাগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে তিন দফায় এ উপজেলায় ১৯০টি ভূমিহীন, গৃহহীন অসহায় পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর গ্রহণ করেছে। তারা নির্ঝঞ্ঝাট এই নতুন ঠিকানায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়ে এখন বেশ ভালো আছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

কুষ্টিয়া জেলার সর্ববৃহৎ উপজেলা দৌলতপুর। ৪৬১ বর্গকিলোমিটারের এই উপজেলাটি পাশের মেহেরপুর জেলার চেয়েও ভৌগলিক আয়তনে বড়। সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী, কৃষিনির্ভর সীমান্তবর্তী এ উপজেলার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮ লাখের মতো। এখানকার অর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বর্তমান সরকারের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে উপজেলায় মানুষের জীবনমানেরও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। অনেক আগে থেকে ঘরে ঘরে টিভি, ফ্রিজ, ইন্টারনেট একেবারেই মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বাইসাইকেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে মোটরসাইকেল। এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মোটরসাইকেল রয়েছে। বাইসাইকেলের মতোই বর্তমানে এখানে কাঁচা ঘরবাড়িও খুব একটা নেই। এমন এক সুখকর বাস্তবতায় এ উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নেয়ার মানুষও এই মুহূর্তে তেমন নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়েছে। যদিও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নঅায়ের মানুষজন বিপাকে পড়েছেন।

জানা যায়, দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরকারি খাসজমিতে এ পর্যন্ত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ১৯০টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম ধাপে ৬১টি পরিবার, একই অর্থবছরে দ্বিতীয় ধাপে ২৭টি পরিবার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে তৃতীয় ধাপে ১০২টি পরিবারকে এই ঘর হস্তান্তর করা হয়। জমির দলিলসহ এসব ঘর বুঝে পেয়ে উপকারভোগী গৃহহীন পরিবারগুলোর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। অনেকে মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ার খুশিতে আত্মহারা হয়ে কান্না ধরে রাখতে পারেননি, ঝরিয়েছেন আনন্দঅশ্রু।

দৌলতপুর উপজেলার হিসনাপাড়া এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর। ছবি: দেশ দর্পণ

প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘরে বসবাসকারীদের বেশিরভাগই দিনমজুরি ও কৃষি শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ কেউ ব্যাটারিচালিত ভ্যান, অটোরিকশা চালিয়েও নিজেদের সংসার চালাচ্ছেন। এটি বিশাল আয়তনের একটি উপজেলা ও এখানকার মোট জনসংখ্যার তুলনায় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের ঘর গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। তবে ঘর প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও শর্ত মোতাবেক এসব ঘর পাওয়ার যোগ্য মানুষ এখন খুব একটা নেই বললেই চলে। যারা রয়েছেন যাচাই-বাছাইয়ে তাদের অনেকে বাদ পড়ছেন। কারো কারো আবার উল্টো শর্তও রয়েছে। কিন্তু তাদের সেই শর্তপূরণ বা পছন্দমতো জায়গায় ঘর দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে এই ঘরের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে আগের মতো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের পক্ষ থেকে গৃহহীনদের কোনো তালিকাও আসছে না।

অনেকে বলছেন, এতবড় একটি উপজেলায় এখনো অনেক গৃহহীন মানুষ থাকতেই পারে স্বাভাবিক। কিন্তু তারা একেকটি স্পটে গুচ্ছ আকারে সারি সারি নির্মিত এসব ঘরে গিয়ে থাকাকে স্বাচ্ছন্দ্যের মনে করছেন না। ভাড়া বাড়িতে অথবা দীর্ঘদিন ধরে ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনদের দেয়া এক টুকরো জমিতে ঘর তুলে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় তারা এখন আর ঠিকানা বদলাতে চাইছেন না। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় এ উপজেলার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। এ কারণে এখানে দারিদ্রতা থাকলেও তা এখানকার মানুষকে খুব একটা প্রভাবিত করে না বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও পরিবর্তিত বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নআয়ের মানুষজন চরম বিপাকে পড়েছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে না থাকায় মানুষ দিন দিন তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বস্তির জায়গা হারিয়ে ফেলছেন।

অন্যদিকে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও এ উপজেলায় গৃহহীনদের বাড়ি করে দেয়া হচ্ছে। আল-সালেহ লাইফ লাইন লিমিটেড নামে কুয়েতভিত্তিক একটি সেবা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব অর্থায়নে বিভিন্ন এলাকায় সাড়ে ৩শ গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটর হাজি হুমায়ন কবির জানান, দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ২৯৫টি এবং উপজেলার বাইরে ৫৫টি গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি করে দেয়া হয়েছে। এই কর্মসূচি এখনো চালু রয়েছে।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার একটি এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর। ছবি: দেশ দর্পণ

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আব্দুল হান্নান জানান, এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর গ্রহণে ইচ্ছুক মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। তার দপ্তরে নতুন কোনো তালিকা আসেনি। সরকারি নিয়ম অনুসারে খাসজমিতে এসব ঘর করে দেয়া হচ্ছে। অনেকে যাচাই-বাছাইয়ের সময় বাদ পড়ছেন। এ ছাড়া কেউ কেউ নিজেদের সুবিধামতো বা কাছাকাছি স্থানে ঘর না পাওয়ায় দূরবর্তী স্থানে যেতে আগ্রহী নয়। সরকার গৃহহীনদের ঘর দিতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে আবেদনকারীদের মধ্যে কেউ যেতে না চাইলে তার কাছ থেকে ঘর না নেয়ার কারণ উল্লেখ করে লিখিত নিয়ে রাখা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘর বরাদ্দ সম্পর্কিত উপজেলা কমিটির সদস্য সচিব, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, ‘উপজেলার পাকুড়িয়া সীমান্ত এলাকায় ২০১৭ সালে নির্মিত দুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসরত ৩০০ পরিবারের মানুষের যাতায়াতের রাস্তা ছিল না। আমরা মাত্র কয়েক মাসের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ভূমি সংক্রান্ত নানা জটিলতা কাটিয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তার জমি বের করে দিয়েছি। পাঁচ বছর পর ইতোমধ্যে সেখানে রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্পের আওতায় এখনো প্রায় ১০০টি পরিবারের বসবাসের জায়গা রয়েছে। কিন্তু আমরা সেখানে ঘর নেয়ার মানুষ পাচ্ছি না।’ এসিল্যান্ড আফরোজ শাহীন খসরু জানান, অনেকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নেয়ার জন্য আবেদন করলেও শর্ত মোতাবেক তারা ঘর পাওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন। আবার অনেককে ঘর দেয়ার জন্য চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সুবিধামতো স্থানে না হওয়ায় পরবর্তীতে তারা ঘর নিতে চাইছেন না। বর্তমানে ঘর করে দেয়ার মতো পর্যাপ্ত খাসজমি রয়েছে। যেখানে অন্তত ৫০০ পরিবারকে ঘর তৈরি করে দেয়া সম্ভব। কিন্তু নিয়মের বাইরে কাউকে ঘর করে দেয়ার সুযোগ নেই। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন করার নির্দেশনা রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, দেশে কোনো পরিবার গৃহহীন থাকবে না- মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এমনটাই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা। আর প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা বাস্তবায়নে এই মুহূর্তে মোটামুটি সফল একটি অবস্থানে রয়েছে দৌলতপুর উপজেলা। কেননা, এ উপজেলায় নতুন করে প্রধানমন্ত্রীর ঘর নেয়ার জন্য তেমন মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। যারা আগ্রহী রয়েছেন তারা অনেকেই ঘর গ্রহণের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন। এমনও রয়েছে, কারো জমি থাকা সত্ত্বেও তা অন্যের নামে দেখিয়ে নিজেকে ভূমিহীন, গৃহহীন দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘর নেয়ার চেষ্টা করেছেন। আবার এর উল্টো চিত্রও রয়েছে। কেউ কেউ ঘর বরাদ্দ পেয়েও শুধুমাত্র দূরবর্তী এলাকা হওয়ার কারণে নিতে রাজি হননি।

অক্টোবর ৩০,২০২২ at ২১:৫৯:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআর/এইচ