করতোয়া ট্র্যাজেডি : মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬৮, এই প্রাণহানির দায় কার?

ছবি; সংগৃহীত

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। তখনো নিখোঁজ ছিলেন অন্তত ৪ জন। অতীতে এমন নৌকাডুবি ও একসঙ্গে এত মানুষের প্রাণহানি দেখেনি পঞ্চগড়বাসী। তাই প্রশ্ন উঠেছে- এত বড় দুর্ঘটনার দায় কার? দায়িত্বশীলরা কি যথাযথভাবে তাদের ভূমিকা পালন করেছেন?

কেননা দুর্গাপূজা ঘিরে এই ঘাট দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষের নদী পারাপার এবারই প্রথম নয়। প্রতি বছরই দুর্গাপূজা ঘিরে এই ঘাটে বিপুল জনসমাগম হয়। সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয় আগাম প্রস্তুতিও। এবারো ঘাটে পুলিশ, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন জনপ্রতিনিধিরাও। তারপরও কীভাবে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে নৌকাটি ঘাট ছাড়ল- এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তাছাড়া পূজার ভিড় হবে জেনেও সেদিন মাত্র দুটি নৌকায় কেন যাত্রী পারাপার করেছেন ইজারাদার, তাও রহস্যাবৃত্ত।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যাপ্ত নৌকার অভাব, অব্যবস্থাপনা আর ইজারাদারের খামখেয়ালির পাশাপাশি পুণ্যার্থীদের সচেতনতার অভাবেই এই ভয়াবহ নৌকাডুবি আর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অথচ একটু সতর্ক থাকলেই এতগুলো প্রাণ রক্ষা করা যেত।

দুর্ঘটনার সময় তীর থেকে ধারণ করা একটি মোবাইল ভিডিওতে দেখা যায়, ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ লোক নিয়ে প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থায় ধীরে ধীরে নৌকাটি পার হওয়ার চেষ্টা করছে। একাধিক মানুষ পাড়ে দাঁড়িয়ে সেই প্রায় ডুবন্ত নৌকার পার হওয়া দেখছেন। এ সময় কেউ একজন হ্যান্ডমাইকে বলে ওঠে- ‘এই মাঝি সাবধানতা অবলম্বন করেন’। বাক্যটি দু’বার বলতে বলতে উল্টে যায় নৌকা। চারপাশে তখন চিৎকার ‘এই ধরো ধরো ধরো’। ‘এই ধরো ধরো উঠাও’, এই চিৎকারে শেষ হয় ভিডিওটি।

আরো পড়ুন :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন আজ

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা আউলিয়া ঘাটের পানির উচ্চতা উল্লেখ করে গণমাধ্যমকে বলেন, সেখানে বেশিরভাগ সময় হেঁটেও পার হওয়া যায়। এখন বর্ষা মৌসুম। আউলিয়া ঘাটে একটা খেয়াঘাট আছে। আপনারা ভিডিও দেখেছেন, যেখানে মাঝিকে সাবধানে যেতে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই নৌকা ঘাট ছেড়ে কীভাবে গেল। কেউ বলল না, দুইবারে পার হও! দায় কার উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, খেয়াঘাটের ডাক হয় প্রতিবছর। সেটার কিছু নিয়ম আছে। ভাড়া কত হবে, একবারে কত জন লোক নেবে, নৌকা ঠিকঠাক আছে কিনা, দেখার কথা। এসব যারা করেন না এবং যারা নিজেরা এতগুলো মানুষ চড়ে বসলেন এক নৌকায়, তারা কেউই দায় এড়াতে পারবেন না।

সেদিনের নৌকা দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে বোদা ফায়ার স্টেশনের বেশ কয়েকজন সদস্য, বোদা থানা পুলিশ ও মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু আনসার মো. রেজাউল করিম শামীম উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয়রা বলছেন, এতজন দায়িত্বশীল মানুষ সেখানে থাকলেও তারা কেন নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে বাধা দিলেন না? তারা যদি নৌকায় এত মানুষকে উঠতে না দিতেন, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না।

প্রতিদিনই আউলিয়ার ঘাট এলাকায় একটি নৌকা থাকলেও সেদিন দুটি নৌকা ছিল বলে জানা গেছে। অতিরিক্ত যাত্রী পারাপারে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু আনসার মো. রেজাউল করীম শামীম। তবে তিনি এ ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করছেন স্থানীয়রা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান শামীম বলেন, সেদিনের ওই নৌকায় আমারো ওঠার কথা ছিল। কিন্তু নৌকায় বেশি মানুষ ওঠায় আমি নৌকা থেকে নেমে যাই। মানুষজনকে নেমে যেতে বলি। কিন্তু কেউ কারো কোনো কথা শোনেনি। আসলে সেদিন পূজা-আর্চনার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছিল বলে এত মানুষের ভিড় হয়েছিল।

বোদা উপজেলা মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার অনিল কুমার বলেন, আমি সেদিন আমার পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়েছি। সেদিন চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনের লোকজন ছিল তারা কেন লোকজনকে নৌকাতে উঠতে বারণ করল না। তাহলে তো আমার স্বজনদের হারাতে হতো না। স্বজন হারানোর কী ব্যথা, যে হারায় সেই বোঝে।

রংপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক জসিম উদ্দীন বলেন, সেদিনের পূজা-অর্চনার সময় ঘাটে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্য ছিল। তারা মানুষজনকে নদী পারাপারে সাহায্য করেছিল। মানুষের নিরাপত্তায় তারা সেখানে ছিল। কিন্তু পূজার সময় শেষ হয়ে আসায় নৌকায় বেশি মানুষ ওঠে। কেউ সেদিন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের কথা শোনেনি।

দুর্ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মাড়েয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মশিয়ার রহমান। তিনি বলেন, এত বড় আয়োজনে ইজারাদারের কোনো সতর্কতা কিংবা প্রস্তুতি ছিল না। মহালয়া উপলক্ষে মানুষের চাপ হবে, এটা সবার জানা। কিন্তু চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁশের ব্যারিকেডের ব্যবস্থা ছিল না। আবার এত মানুষের জন্য বড় নৌকা ছিল মাত্র একটি। আরেকটি নৌকা থাকলেও সেটি ছিল বেশ ছোট। সুতরাং এই দুর্ঘটনা ও বিপুল প্রাণহানির জন্য দায়ী ঘাটের ইজারাদার। তিনি আরো বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে বদেশ্বরী মন্দির কমিটিরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তারা জানত এদিন মানুষের চাপ বাড়বে। তারা ইজারাদার বা প্রশাসনকে নৌকা বাড়াতে বলতে পারতো।

তবে মাড়েয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অখিল রায় দাবি করেছেন, বদেশ্বরী মন্দির পূজা উদযাপন কমিটি ঘাট ইজারাদারের সঙ্গে বসে মহালয়ার দিন নৌকার সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ করেছিল। অন্তত ছয়টি নৌকার ব্যবস্থা রাখার জন্য বলা হয়েছিল, কিন্তু তারা সেটা করেননি। অখিল রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা (ইজারাদার) জানেন যে প্রতি বছর এই সময় ঘাটে প্রচণ্ড ভিড় হয়। কিন্তু ভিড় সামলানোর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যার ফলাফল এত প্রাণহানি।

ইউনিয়ন পরিষদের দেয়া তথ্যমতে, আউলিয়ার ঘাট পঞ্চগড় জেলা পরিষদের অধীন ইজারা দেয়া হয়। ঘাটটির বর্তমান ইজারাদার আব্দুল জব্বার। তিনি জেলার বোদা উপজেলার কুমারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এদিকে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি মনে করছে, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপেই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর রায় সাংবাদিকদের বলেন, ভয়াবহ নৌকাডুবির ঘটনায় পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয়। আজকের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। আমরা ইতোমধ্যে সব ভিডিও ডকুমেন্টস সংগ্রহ করেছি। প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। দুই পাড়ের মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে এ ভয়াবহ নৌকাডুবির ঘটনাটি ঘটে।

অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ মোকাবিলায় ও ঘাট ব্যবস্থাপনায় ইজারাদারের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা, এমন প্রশ্নে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, আমরা ইজারাদারকে খুঁজে পাচ্ছি না। সম্ভবত তিনি পলাতক। তদন্তে সবদিক খতিয়ে দেখা হয়েছে। এই দুর্ঘটনার জন্য যাত্রীদের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়।

পঞ্চগড় জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ সানিউল কাদের বলেন, জেলা পরিষদ খেয়াঘাটের ইজারা দিলেও নৌযানের তদারকি ও যাত্রী পারাপারের বিষয় দেখে স্থানীয় প্রশাসন। এক্ষেত্রে ইজারাদারের কোনো গাফিলতি থাকলে জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটির তদন্তে সেটা বেরিয়ে আসবে। তখন ইজারাদারের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

খেয়াঘাট মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা প্রশ্নে জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, সেদিন পুলিশ, আনসার ও জনপ্রতিনিধিরা খেয়াঘাটে ছিল। তারা লোকজনকে আটকানোর চেষ্টা করেছে। নৌকা ঘাটে ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কে কার আগে যাবে, তড়িঘড়ি করে উঠেছে। সাবধান করে লাভ হয়নি। কী করে এত যাত্রীসহ নৌকা ছাড়ল, সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।

সেপ্টেম্বর ২৮,২০২২ at ০২:১৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক /দেপ/শই