দফায় দফায় আকাশসীমা লঙ্ঘন মিয়ানমারের, মুহুর্মুহু গোলা ও গুলির আওয়াজ

সীমান্তে আকাশসীমা লঙ্ঘন করেই চলেছে মিয়ানমার। ছবি: সংগৃহীত

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তুমব্রু ও বাইশফাঁড়ি পয়েন্টের বিপরীতে মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমান দেশের বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে গোলা ছুড়েছে। শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাত পৌঁনে ১১টায় এ গোলা বষর্ণ করে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। এছাড়াও শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালে আরেক দফা দেশটির যুদ্ধ বিমান থেকে গোলা বর্ষণ করা হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

স্থানীয়দের দাবি, দফায় দফায় সতর্ক আর প্রতিবাদ জানানোর পরও আকাশসীমা লঙ্ঘন করেই চলেছে মিয়ানমার। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত অন্তত দুবার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে দেশটির বাহিনী।

স্থানীয় লোকজনের দাবি রাত নামলেই শুরু হয় মিয়ানমার বাহিনীর তাণ্ডব। রাতের ঘুম হারাম করে সে দেশের বর্মী বাহিনীর বিচরণে ও যুদ্ধ বিমানের গোলা এবং মর্টার শেলের বিকট শব্দে কেপে উঠে সীমান্ত। সেই শেলের শব্দে তুমব্রু উত্তর পাড়ার নু আহমেদ এর বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে ফাটল ধরে গেছে।

তুমব্রু বাজার ব্যবসায়ী বদিউল আলম ও আবদুল কাদের এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, প্রতিদিন নতুন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে মিয়ানমার। বাংলাদেশ সীমান্ত পরিবেশ জটিল করছে দেশটি। সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘর্ষে মুহুর্মুহু গোলা ও গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে এপারে। এতে আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের। গোলার কম্পনের জেরে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু ও বাইশফাঁড়ি এলাকায় ফাটল ধরেছে বিভিন্ন বাড়িঘরে।

গত ২৮ আগস্ট মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা দুটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ঘুমধুমের তমব্রুর উত্তর মসজিদের কাছে পড়ে। এ ঘটনায় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর ঘুমধুম এলাকায় দুটি গোলা পড়ে। এ ঘটনায়ও প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু তার পরও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। ৯ সেপ্টেম্বর আবার গুলি এসে পড়ে। ১৬ সেপ্টেম্বর মাইন বিস্ফোরণ ও গুলি-মর্টার শেল নিক্ষেপে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনায় মিয়ানমারের কূটনীতিককে আবারও তলব ও কড়া প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শুধু তা-ই নয়, বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও বিষয়টি তুলেছে মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলেছেন। এর পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই।

মিয়ানমারের দাবি, তাদের ভূখণ্ডে আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে লড়ছে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে পড়া গোলাগুলো আরাকান আর্মির ছোড়া। তবে বাংলাদেশে এসে পড়া গুলির কোনো ব্যাখ্যা তারা দেয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাত নামলেই সীমান্তের ওপারে বেড়ে যায় গোলাগুলির আওয়াজ। সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারের গর্জন আর গোলা ও মর্টার শেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দে স্থানীয়দের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। শেলের কম্পনে তুমব্রু উত্তরপাড়ায় কয়েকটি বাড়িতে ফাটল ধরেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সীমান্তে টহলরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, গতকাল সকাল ৭টার দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার ৪০-৪১ সীমান্ত পিলার এলাকার ওপর চক্কর দিয়ে গোলা নিক্ষেপ করে।

তুমব্রু বাজার সর্বজনীন দুর্গামন্দির কমিটির সভাপতি রুপলা ধর বলেন, মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা তুমব্রুর ওপারের ক্যাম্প থেকে গতকাল সকাল ১০টায় সে দেশের অভ্যন্তরে একটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। এই আওয়াজে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বাইশফাঁড়ির এসএসসি পরীক্ষার্থী আয়শা বেগম বলে, শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে গোলার শব্দে আতঙ্ক ছড়ালেও কিছুটা সহনীয় ছিল। কিন্তু শনিবার সকালে গোলাগুলির আওয়াজ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছে। ভয়ে ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছি।তুমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী বদিউল আলম ও আবদুল কাদের বলেন, প্রতিদিন নতুন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে পরিবেশ জটিল করছে। তারই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার রাত পৌনে ১১টায় রাখাইন প্রদেশের মংডু জেলার উত্তরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পিলার ৩৭, ৩৮, ৩৯ এলাকায় মিয়ানমার বিমান বাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমান থেকে ভারি অস্ত্রের গোলা বর্ষণ করা হয় সে দেশে। এর একটি বিমান মিয়ানমার থেকে এসে তুমব্রু পয়েন্টের জিরো লাইনের সোজা উপর দিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যায়। আর মর্টার শেলের গোলা বর্ষণ করে। এতে তুমব্রু বাজার, কোনার পাড়া, মধ্যম পাড়া ও উত্তর পাড়ার বসতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ ঘটনায় মিয়ানমারের ভেতরে হতাহতের কোনো খবর জানা যায়নি।

এছাড়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে টহলরত মাঠ পর্যায়ের একজন বিজিবি কর্মকর্তা জানান, গতকাল শনিবার সকাল ৭টার দিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমান ৪০/৪১ সীমান্ত পিলার এলাকায় টহল দেয় এবং গোলা নিক্ষেপ করে। তুমব্রু বাজার সার্বজনীন দুর্গা মন্দির কমিটির সভাপতি রুপলা ধর জানান, মিয়ানমার সীমান্ত ঘেষা তুমব্রুর ওপারের ক্যাম্প থেকে গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় সে দেশের অভ্যন্তরে একটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। এ বিষয়ে বিজিবির বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, যুদ্ধবিমান জিরো পয়েন্ট দিয়ে রাতের বেলা কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে। তবে এতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর তিনি পাননি।

তবে চাকমা ও তঞ্চঙ্গা নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন আতঙ্কে আছেন। বাইশফাঁড়ি ও উত্তরপাড়া থেকে পরীক্ষার কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাওয়া অংপ্রæ তংচঙ্গা, আয়সা বেগম ও শারমিন আক্তার বলেন, তারা ভয়ে ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। কেননা রাতে পড়ার সময় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে গোলার শব্দ তাদের আতংকিত করলেও কিছুটা সহনীয় ছিল। কেননা বাড়ির সবাই পাশে ছিল। কিন্তু সকালে গোলাগুলির আওয়াজ ভেদ করে কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় অনেক ভয় তাদের তাড়া করে।

তুমব্রু কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মৌলানা নুরুল আজিম বলেন, শুক্রবার সকালে গোলার আওয়াজে তার এবং মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তার মসজিদটি তুমব্রু সীমান্তের খুবই কাছে। এদিকে, নোম্যানস ল্যান্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, আজকেও (শনিবার ) বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়। আসলে এ ‘গুলিখেলার’ শেষ কবে হবে, তার কোনো হিসাব নেই। আমাদের শিবিরের শিশু ও নারীরা ভয়ে থাকে। আর আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে শুনতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।

নোম্যানস ল্যান্ডে দায়িত্বে থাকা বিজিবির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে জানান, সীমান্তের অবস্থা খারাপ। এখানে লোকজনের চলাচলে সতর্ক করা হয়েছে। জরুরি কাজ না থাকলে এখানকার লোকজনকে ঘোরাফেরা না করতে বলা হয়েছে।

সেপ্টেম্বর ২৫,২০২২ at ০১:২৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ /আক /দেপ /শই