হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে দেশবরেণ্য শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের দাফন সম্পন্ন

দেশবরেণ্য শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাস। -ফাইল ছবি।

হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) রাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার নিজ এলাকায় দেশবরেণ্য শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় শিল্পগ্রুপ নাসির গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজের কর্ণধার দৌলতপুরের গর্বিত সন্তান শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাস সোমবার সকালের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি বেশ কয়েক বছর যাবত কিডনি, হার্টসহ নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। অবশেষে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

এই বরেণ্য শিল্পপতির মৃত্যুর খবরে এখানকার সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকে শোক প্রকাশ করেন। শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ি দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের আল্লারদর্গা বাজারের পার্শ্ববর্তী সোনাইকুণ্ডি গ্রামে। নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ৫০ বছরের বর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী জীবনে বেশ কয়েকটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে সারাদেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডেও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তিনি।

নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ১৯৭২ সালে তামাক ব্যবসা দিয়ে দীর্ঘ ব্যবসায়ী জীবনে প্রবেশ করেন। তামাকের ব্যবসায় সফলতার মাধ্যমে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সফল হয়েছেন। তিনি ১৯৭৬ সালে নাসির বিড়ি ফ্যাক্টরি গড়ে তোলেন। ১৯৭৭ সালে কুষ্টিয়া বিসিক শিল্প নগরীতে নর্থবেঙ্গল প্লাস্টিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ মেলামাইন ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড, বাংলাদেশ ফুটওয়্যার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড, ১৯৯৬ সালে নাসির টোব্যাকো, এরপর নাসির লিফ টোব্যাকো ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড, ২০০০ সালে রিড্রাইং প্লান্ট ও বিশ্বাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস লিমিটেড, ২০০২ সালে নাসির গ্লাস ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড, নাসির এনার্জি সেভিং ল্যাম্প ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং নাসির স্টার্স কোম্পানি লিমিটেডসহ ডজনখানিক বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তিনি নিজের নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সফলতম শিল্পোদ্যোক্তা নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের মরদেহ সোমবার রাতে ঢাকা থেকে দৌলতপুর উপজেলার সোনাইকুণ্ডি গ্রামের নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এর আগে ঢাকায় তার তিনটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সোনাইকুণ্ডি গ্রামে বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ইদ্রিস আলী বিশ্বাস ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও গোরস্থান মাঠে রাত ১০টায় জানাজা শেষে সেখানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের জেষ্ঠ্যপুত্র নাসিম বিশ্বাস বাবার জানাজা নামাজ পড়ান।

জানাজায় দৌলতপুর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী, বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শরিফ উদ্দিন রিমন, স্থানীয় হোগলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সেলিম চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সর্বস্তরের কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

দৌলতপুর উপজেলার আল্লারদর্গা এলাকাকে নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ও তাদের পরিবার কার্যত একটি শিল্পাঞ্চলে পরিণত করেছেন। তার ছোট ভাই আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ্বাসও একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। তিনি জামান গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাদের তৈরি নিজ এলাকার এই শিল্পাঞ্চলটির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। এই শিল্পপতি পরিবারের এসব ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে সারাদেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

এ ছাড়া প্রয়াত শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের শিক্ষা, চিকিৎসা ও নানা সেবাখাতেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি দৌলতপুর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এগুলো সরকারিকরণ করা হয়। আল্লারদর্গায় প্রতিষ্ঠা করেন নাসির উদ্দিন বিশ্বাস বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পরবর্তীতে এটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) উন্নীত করা হয়। তিনি মায়ের নামে আল্লারদর্গায় প্রতিষ্ঠা করেন রহিমা বেগম একাডেমি, যা পরবর্তীতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। উপজেলার বড়গাংদিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ডিগ্রি কলেজ। বর্তমানে আল্লারদর্গায় নাসির উদ্দিন বিশ্বাস পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সেখানে সুবিশাল পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।

অন্যদিকে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং চিকিৎসা সেবায় স্ত্রীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত আনোয়ারা বিশ্বাস মা ও শিশু কেন্দ্র এখানকার প্রসূতি মা ও শিশুদের চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এই জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান থেকে বহু মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে এটি এখন এক অনন্য উচ্চতায় এসে পৌঁছেছে। গরিব ও অসহায় রোগীদের জন্য চালু রয়েছে বিনা খরচায় চক্ষু চিকিৎসা শিবির। এ ছাড়া গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর নাসির উদ্দিন কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, বিশিষ্ট সমাজসেবী শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ১৯৪৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুর উপজেলার সোনাইকুণ্ডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইদ্রিস আলী ও মাতার নাম মোছা. রহিমা বেগম। তিনি ১৯৬৭ সালে আল্লারদর্গা মাধমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭১ সালে একই কলেজ থেকে বিকম পাশ করেন। ওই বছরই তিনি বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। ৩ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন দ্বিতীয়। মূলত কৃষি কাজের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে তামাক ব্যবসার মাধ্যমে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেন তিনি। এরপর কর্মনিষ্ঠা আর মেধার সমন্বয়ে একে একে গড়ে তোলেন অন্তত ১২টি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। তিনি ব্যবসা ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করায় সরকারি, বেসরকারি নানা পুরস্কার লাভ করেছেন।

সেপ্টেম্বর ১৩,২০২২ at ১০:৫০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ /আক /এসআর /শই