চৌগাছার বলুহ মেলা চাননা গ্রামবাসী ও সচেতন মহল

যশোরের চৌগাছার হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান মেলা বন্ধের জন্য পৃথকভাবে আবেদন জানিয়েছেন স্থানীয় গ্রামবাসী, হাজরাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক এবং বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা।

মেলা চলাকালে মাসব্যাপী গ্রামের একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ থাকা, শিক্ষার্থীদের সড়ক দূর্ঘটনা ও হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা, গ্রামবাসীর বসবাসের পরিবেশ রক্ষা, চাঁদাবাজি বন্ধ, মারামারি (খুন-খারাবি), দেহব্যবসা, অশ্লীলতা, মাদক সেবন থেকে যুব সমাজকে রক্ষার জন্য মেলা বন্ধ রাখার দাবি জানানো হয়েছে আবেদনগুলিতে।

হাজরাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মনিরুজ্জামান মিলন ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খাদিজা খাতুন গত ৪ সেপ্টেম্বর চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত এক আবেদনে জানান, ‘আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর-২০২২ থেকে ঐতিহ্যবাহী পীর বলুহ দেওয়ান মেলা’ হাজরাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গন ও এর আশেপাশের এলাকাজুড়ে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে।

এসময় বিদ্যালয়ের মাঠ, শ্রেণিকক্ষ মেলার ষ্টল ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্য দ্বারা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির ৩১/০৮/২০২২ খ্রিঃ তারিখের সভায় সকল সদস্য বিদ্যালয়ের মাঠ, শ্রেণিকক্ষ মেলার ষ্টল ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্য দ্বারা যেন ব্যবহৃত না হয় এর পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

মেলা চলাকালীন বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম চালু রাখতে হলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা (যেমনঃ হাত-পা কেটে যাওয়া, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া, বাচ্চা ছেলে-মেয়ে হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি) ঘটতে পারে।’ এতে মাসব্যাপী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম দারুনভাবে বিঘ্ন হয়।

এসব বিষয় পর্যালোচনা করে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে কি ব্যবস্থা বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি গ্রহণ করতে পারে তার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে আবেদনটিতে। একইসাথে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে এ সময়কালে (মেলার অনুমতি দেয়া হলে সেসময়ে) বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদনও জানানো হয়েছে লিখিত দরখাস্তটিতে।

এর আগে গত ২৮ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে মেলায় অশ্লীল নৃত্য, নোংরামি, চাঁদাবাজি, মারামারি বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে একটি গণসাক্ষরকৃত লিখিত আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন গ্রামবাসী। সেখানে তারা বলেছেন, ‘হাজরাখানা গ্রামে বলু দেওয়ান নামে একটি মাজার আছে।

যা প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার ওরশ-মাহফিল হয়ে থাকে। বলু দেওয়ানের মাজারে কিছু ভক্ত অনুসরীরা এই ওরশ-মাহফিলে অংশ নেয়। ওরশ-মাহফিলের পাশাপাশি বিগত বছরগুলোতে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। বর্তমানে কয়েক বছর যাবত মেলায় জুয়া খেলা, পুতুল নাচ, ভ্যারাইটি শো, সার্কাস যাদু খেলার আসরে অশ্লীল নৃত্য, গান-বাজনাসহ মাদকের ব্যবহার এত বেশি পরিমাণে চলে যা আমাদের বাসা-বাড়িতে বসবাসের খুবই সমস্যা, পাড়া,

মহলা ও গ্রামের তরুণ যুব বয়সের ছেলেদের মধ্যে এত বেশি পরিমানে আকর্ষণ সৃষ্টি করে যার কারনে পরবর্তীতে লেখাপড়া ও পিতামাতার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অশ্লীল নৃত্যের নামে যে নোংরামী হয় তাতে যুবসমাজ ধ্বংসের শেষ দিকে নিয়ে যায়।

মেলায় দোকান বরাদ্দের নামে লক্ষলক্ষ টাকা চাঁদাবাজি হয়। স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রতি দোকান থেকে চাঁদাবাজি করে এবং পরবর্তীতে ভাগাভাগি নিয়ে এলাকায় নিয়মিত মারামারি লেগেই থাকে। মেলা বিগত বছরগুলোতে ১ থেকে দুই নি হতো, বর্তমানে দশ থেকে ১৫ দিন চলার কারনে এলাকার ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া, স্কুল-মাদরাসায় যাওয়া আসার খুবই সমস্যা হয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে আবেদনটিতে।

এছাড়া হাজারাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর অপর একটি লিখিত আবেদনে বলেছেন, ‘প্রতিবছর পীরের নামে যে বাজার হয়। তাতে গ্রামের দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (হাজরাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা) মেলা চলাকালীন বন্ধ থাকে।

ফলে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার চরম ক্ষতি হয়। তাছাড়া জান-মালের হুমকি, জুয়া, গাঁজা, মদসহ দেহব্যবসার মত জঘন্য অপরাধ সংঘঠিত হয়। যার সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রীরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ে। এ থেকে উত্তরনের জন্য মেলা বন্ধ রাখার জোর দাবি জানান তারা।’

গ্রামের দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জানান, গত তিন বছর ধরে বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম না হওয়ায় এমনিতেই শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুই ভুলে গেছে। তারা অনেক নিয়মকানুনও ভুলে গেছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’দিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমন সময়ে মেলার অনুমতি দিলে কমপক্ষে ১০/১৫ দিন বিদ্যালয় ও মাদরাসা বন্ধ রাখতে হবে।

এতে প্রতিষ্ঠান দু’টির আট শতাধিক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। একইসাথে সমগ্র চৌগাছা উপজেলার শিক্ষার্থীদের মাঝে মেলায় যাওয়ার প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ায় উপজেলার শিক্ষা ব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এজন্য তারা মেলাটি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম মোঃ রফিকুজ্জামান বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে বিষয়টি নিয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত করা হয়। এসময় শুনানিকালে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মনিরুজ্জামান মিলন ও প্রধান শিক্ষকসহ অভিভাবক ও গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলা হয়।

এছাড়াও বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক, গ্রামবাসীরা গণ স্বাক্ষরিত এবং অভিভাবকরা আলাদাভাবে তিনটি লিখিত আবেদন করেছেন মেলার নামে মাদক ও জুয়া, চাঁদাবাজি, মারামারি, অশ্লীলতা বন্ধের জন্য। এসব বিষয় বিবেচনা করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা, স্থানীয় গ্রামবাসীর বসবাসের পরিবেশ এবং চাঁদাবাজি, মারামারি, অশ্লীলতা ও মাদক সেবন থেকে যুব সমাজকে রক্ষার জন্য মেলা বন্ধ রাখা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তিনি বলেন এই প্রতিবেদন গত ৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তিনজন কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। কমিটি তদন্ত করে স্থানীয়দের বক্তব্য, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষককের লিখিত আবেদনসহ একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। সেটি গত সোমবারই ( ৫সেপ্টেম্বর) ডিসি স্যারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলি জানায়, করোনা অতিমারির কারনে গত তিন বছর মেলা বন্ধ থাকলেও চলতি বছর স্থানীয় নারায়নপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান শাহিনকে সভাপতি এবং হাজরাখানা গ্রামের ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মিলন সদস্য সচিব করে একটি কমিটি যশোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর মেলা অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন।

আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে এক সপ্তাহের অনুমতি চাওয়া হয়েছে আবেদনে। আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা দেন। নির্দেশনার আলোকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা চৌগাছা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা (প্রাথমিক) শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়

স্থানীয়রা জানান, প্রতি বাংলা সনের ভাদ্রমাসের শেষ মঙ্গলবার উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে পীর বলুহ দেওয়ানের দরগাহ ঘিরে দীর্ঘ দিন ধরে হয়ে আসছে ওরস শরীফ ও মেলা। প্রতি বাংলা সনের ভাদ্রমাসের শেষ মঙ্গলবার মাজার ও ওরশ শরিফ ঘিরে মাজারে মানত শোধ করতে আসা মানুষের সুবিধার্থে শুরু হয় বাজার অর্থাৎ মেলা।

আগে মঙ্গলবার মেলার প্রধান দিন, বুধবার বউবাজার এবং বৃহস্পতিবার হতো ভাঙাবাজার। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাজারকে কেন্দ্র করে পূর্বে কপোতাক্ষ নদের তীর থেকে শুরু করে গ্রামের মাঝের হাজরাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ও তৎসংলগ্ন মাঠগুলিসহ পশ্চিমে চৌগাছা-মহেশপুর সড়কের হাজারাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তার দুই ধার ঘেষে বৃহৎ আকারে মেলা শুরু হয়। ৭ থেকে ১৫দিনব্যাপী জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে এই মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।

তবে সাম্প্রতিককালে মেলাকে কেন্দ্র করে ব্যপক জুয়াখেলা, মাদকের বিকিকিনি, চাঁদাবাজি, মারামারি বেড়েই চলেছে। মেলার চলাকালিন আশেপাশের গ্রামগুলির নিম্নবর্ণের সংখ্যালঘু পরিবারগুলির মেয়েদের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাও ঘটে চলে নিরবে নিভৃতে। যদিও সম্মান এবং ভীতির কারনে মুখ খুলতে চাননা তারা। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে মেলা থেকে ফিরে চৌগাছা বাজারে নৃশংসভাবে খুন হন তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাশাপোল ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুল।

তাকে নির্মমভাবে বোমা মেরে ও গুলি করে উপজেলা আওয়ামীলীগের অফিসের পাশেই হত্যা করা হয়। মেলার টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে বলে জনশ্রæতি রয়েছে। এছাড়া ২০০৩ সালে মেলায় তৎকালীন বিএনপির নেতাদের আশ্রিত সন্ত্রাসীরা ব্যপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটায়। যাতে ঘটনাস্থলে ও পরবর্তীতে হাসপাতালে ৩ব্যক্তি নিহত হন। পরে বোমাবাজদের একজনও মারা যায়।

সেপ্টেম্বর ০৬,২০২২ at ১৮:৪৭:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ /আক /মই /শই