প্রশাসনিক কর্যক্রমে জাবি উপাচার্যের নিয়ন্ত্রণ নেই!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সড়কে স্থায়ী ব্যারিকেড বসানো, আবাসিক হলে র‍্যাগিং ও নির্যাতনের বিচার না হওয়া এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের নিয়ন্ত্রণ নেই বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের সামনের সড়কে স্থায়ী ব্যারিকেড বসিয়েছেন কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক। তিনি অনুমতি ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নিলেও জবাবদিহি করতে পারেনি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। অন্যদিকে প্রশাসন দাবি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে শিক্ষকদের একটি পক্ষ সড়কে স্থায়ী ব্যারিকেড বসিয়েছে।

আরো পড়ুন :
রংপুরে মুখোমুখি দুই বাসের সংঘর্ষে নিহত ৮

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রধান সড়কে অনিয়মতান্ত্রিক ব্যারিকেড স্থাপনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এমন কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে দায়িত্বশীলদের অদূরদর্শীতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ ঘটনায় উপাচার্যের মহোদয়ের আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন ছিল, যেটি করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অফিস প্রধানের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি যেকোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ শিক্ষকদের সহযোগিতা নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের অভিযোগ, অধ্যাপক নূরুল আলম উপ-উপাচার্যের (শিক্ষা) দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষককে একাডেমিক কাজে সহযোগিতা করতে পারেননি। এছাড়া তিনি শিক্ষকতা পেশায় একাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে পারেননি।

এদিকে গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল ও মওলানা ভাসানী হল ছাত্রলীগের মধ্যে মারামারির ঘটনায় বটতলার দোকান ভাঙচুর করে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনার পরের দিন মওনালা ভাসানী হল ছাত্রলীগের এক কর্মীকে মারধরের ঘটনা ঘটে। ফলে ছাত্রলীগ নেতাদের চাপে মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যে শৃঙ্খলা কমিটির সভা ডেকে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে ছাত্রলীগের হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে চলমান স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এছাড়া শহীদ রফিক-জব্বার হল সংলগ্ন নবনির্মিত আবাসিক হলের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠে শহীদ রফিক-জব্বার হল ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে। তবে এসব বিষয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এছাড়া গত ২ আগস্ট মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে এক সাংবাদিককে র‍্যাগিংসহ নানা ধরনের শারিরীক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাংবাদিকদের দাবির প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে হল কতৃপক্ষ। পরে দীর্ঘ একমাস পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও কোন অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারেননি। অথচ ঘটনার রাতে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত ৮ জনকে চিহ্নিত করে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে অবাঞ্ছিত করা হয়।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, তদন্ত কমিটি তৃতীয় পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে অপূর্ণাঙ্গ একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সংকুচিত করে ভূলভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে শৃঙ্খলা কমিটি উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠন করা ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে তদন্ত কমিটির এমন ‘গাফিলতি’ ও পক্ষপাতমূলক আচরণের বিষয়ে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি অধ্যাপক মো. নূরুল আলম।

তদন্ত কমিটির প্রধান সহযোগী অধ্যাপক আলী আকবর তার নিজের বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। তবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফিসহ শৃঙ্খলা কমিটির আরও ৪ সদস্য দাবি করেছেন, তারা শৃঙ্খলা কমিটির সভায় অভিযুক্ত ৮ ছাত্রলীগ কর্মীর শাস্তির সুপারিশ করেন। কিন্তু শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য সচিবসহ অন্যরা সেই সুপারিশ আমলে নেননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য বলেন, শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আমরা চার হলের প্রভোস্ট সাংবাদিক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের সুপারিশ করেছিলাম। তবুও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বাইরে উপাচার্য নির্বাহী ক্ষমতায়ও তাদের শাস্তি দিতে পারতেন। আসলে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দিতে প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব ছিল।

অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি বলেন, তদন্ত কমিটির পাঠানো নথি খুলে দেখার এখতিয়ার আমার নেই। তাই সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছি। তদন্ত কমিটির কাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য সচিব আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন। এমনকি তারা অভিযোগপত্র প্রতিবেদনে যুক্ত করেনি। এছাড়া প্রতিবেদনে দোষীদের চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে আমরা তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। আমরা অধিকতর তদন্তের স্বার্থে অন্য একটি কমিটি গঠন করেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভাজনের বিষয়ে জানা যায়, গত ১২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়ে শিক্ষকরা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের’ বিভাজন স্পষ্ট হয়৷ তারা মোট দু’টি প্যানেলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে একটি প্যানেলের নেতৃত্বে ছিলেন, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম এবং আরেকটি প্যানেলের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি।

এছাড়া ভিসি অধ্যাপক মো. নূরুল আলম দায়িত্বে আসার পর র‍্যাগিংয়ের ঘটনায় জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষনা করেন। তবে অধিকাংশ হলের প্রভোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিকে অবস্থান না করা ও নিয়মিত হলের কার্যক্রম তদারকি না করায় ছেলেদের হলগুলো নিয়মিত র‍্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সুফিয়া কামাল হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মওলানা ভাসানী হল, শহীদ সালাম বরকত হল, মীর মশাররফ হোসেন হল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শেখ হাসিনা হল, নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল ও প্রীতিলতা হলের প্রাধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত আবাসিক ভবনে থাকেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে অবস্থানরত ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রায়ই মধ্যরাতে বড়ভাইয়েরা গনরুমে আসেন। আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। মাঝে মাঝে গায়েও হাত তুলেন।

অন্যদিকে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের মাস্টারপ্লান নতুন করে প্রনয়নসহ কয়েকটি দাবি জানিয়েছে ‘দূর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ প্লাটফর্মের আন্দোলনকারীরা। তারা দাবি আদায়ের লক্ষে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে চিঠি দিয়েছে। তবুও ভ্রুক্ষেপ করেনি উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমপন্থী প্রশাসন।

এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি রাকিবুল হক রনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের একেবারেই তুচ্ছ ভাবে। শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নয়নের বুলি আওড়ায়, অথচ তাদের সাথে কোন কথা বলে না। আবার কথা বললেও কোনো গুরুত্ব দেয় না। শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা ভাবার বিষয়ে বর্তমান প্রশাসনের নজির নেই। ফলে স্পষ্টত যে, বর্তমান প্রশাসন তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে অযোগ্যতার প্রমান দিচ্ছে।

‘দূর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ প্লাটফর্মের মুখপাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আরেকটি প্রশাসনিক ভবন নির্মানের প্রয়োজনীয়তা নেই। এমনকি যেখানে নতুন প্রশাসনিক ভবনের পরিকল্পনা আছে, তার পাশেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক যা সার্বক্ষণিক শব্দদূষণ করতে থাকে। যেখানে সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অংশীজনের সাথে আলোচনা ছাড়াই এমন কার্যক্রম করা হলো- প্রশাসনের অযোগ্যতার প্রমান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। তিনি যেকোন কাজে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষকের দ্বারা প্রভাবিত হন ও তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেন বলেও অভিযোগ করেছে শিক্ষকদের একটি অংশ। শিক্ষকদের একটি অংশের দাবি, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের অদক্ষতা প্রমানিত হয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এর আগে, উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম সড়কে ব্যারিকেড দেওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। এছাড়া সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা তিনদিন সময় নিয়েছি। এর মধ্যে, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করবো।

সেপ্টেম্বর ০৫,২০২২ at ১৩:৫৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ /আক /নর /শই