ভাঙল বনগাঁ কালিতলা পার্কিং সিন্ডিকেট: বেনাপোলে আমদানি বাণিজ্যের গতি ও স্বস্তি ফিরেছে

অবশেষে ভারতের বনগাঁ পৌরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন কালিতলা পার্কিংয়ের সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্তি পেলেন ব্যবসায়ীরা। এতে আমদানি বাণিজ্যে গতি ও স্বস্তি ফিরেছে বেনাপোল বন্দরে। চাঁদাবাজি ও হয়রানির অভিযোগে বনগাঁ পৌরসভার কাছ থেকে কালিতলা পার্কিংয়ের দায়িত্ব সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহন দফতরকে দেয়ায় গত সপ্তাহ থেকে এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেড় মাসের সিরিয়াল থেকে কমে এখন ৪ দিনের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করছে।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের ঢোকার আগেই বনগাঁ পৌরসভার কর্তারা জোর করে ট্রাক ঢুকিয়ে দিত বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে। সেখানে সিরিয়ালের নামে দেড় মাস পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাক আটকে রাখা হতো। ট্রাক প্রতি আদায় করা হত ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি আমদানিতে বিলম্ব হওয়ায় ব্যাহত হত শিল্পকলকারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া। প্রায় দুই যুগ ধরে চলছিল এ চাঁদাবাজি। তবে এসব চাঁদাবাজির সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত থাকায় ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ জানালেও, এতদিন কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

অবশেষে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করলে সমাধানের দায়িত্ব পায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বর্তমানে কালিতলা পার্কিংয়ে ট্রাক না ঢুকিয়ে অনলাইনে পণ্য চালান এন্ট্রি করে সরাসরি চলে আসছে বেনাপোল বন্দরে। এ সেবা পেয়ে খুশি ব্যবসায়ীরা।

আরো পড়ুন:
অভয়নগরে বসতবাড়ি থেকে সাড়ে ৮ কেজি গাজার গাছসহ আটক ১
পাবনায় ৯ কেজি গাঁজাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

এ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ট্রাক প্রতি ১০ হাজার ও ট্রাক চ্যাচিস প্রতি ৫ হাজার রুপি চার্জ নির্ধারণ করেছে। তাই টাকার পরিমাণ কমানোর দাবি বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের। এবিষয়ে সিঅ্যন্ডএফ ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী জানান, সরকারের এমন পদক্ষেপে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে আমদানিকারকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। কেননা, পণ্য দ্রæত পরিবহন করা যাচ্ছে। ভারতীয় ট্রাক চালক অনিমেস জানান, আগে দেড় মাস পর্যন্ত কালিতলা পার্কিংয়ে থাকতে হত। এখন ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে ঢোকা যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন উদ্যোগে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা খুশি উল্লেখ করে বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশেন সহ-সভাপতি কামাল হোসেন জানান, তবে সেবা চার্জ পণ্যবাহী ট্রাক প্রতি ১০ হাজার রুপি ও ট্রাক চ্যাচিজ চার্জ ৫ হাজার রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থের পরিমাণ কিছুটা কমালে ব্যবসায়ীরা আরও উপকৃত হবেন

বাংলাদেশ-ভারত ল্যান্ড পোর্ট চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, পণ্যের মূল্য ও ট্রাক ভাড়া ছাড়া প্রতি বছর কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা শুধু কালিতলা পার্কিং ডিটেনশন চার্জ বাবদ দেয়া হয়েছে। স¤প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সদ্বিচ্ছা ও মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে বনগাঁ কালিতলা পার্কিং সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হয়। দিল্লি, বোম্বেসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হতে একটি ট্রাক আসার পর লোকাল গোডাউনে আনলোড করে রাখা হয়। পরবর্তীতে সেই একই পণ্য দুইটি ট্রাকে লোড করে বেনাপোলে পাঠানো হয় যা ঋণ পত্রের শর্ত বহির্ভূত। এলসি তে পার্ট শিপমেন্ট অনুমোদন থাকলেও ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে। বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেট ট্রাকের ভুয়া নম্বর দিয়ে এন্ট্রি করে রাখা হত। পরবর্তীতে সেই সিরিয়াল নম্বর ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হত।

তিনি বলেন, স¤প্রতি বিভিন্ন পণ্যের ইনভয়েজের মূল্যের সঙ্গে মালবাহী ট্রাকের চার্জের উল্লেখ করা হয়েছে। তা বিশ্লেষণ করে যায়, একটি গøশ ইন্ডাস্ট্রিজের আমদানি করা কেমিক্যাল ব্রীক্স ৪টি ট্রাকে আমদানি হয়েছে। সেখানে ডিটেনশনসহ মালবাহী চার্জ ৮ হাজার ডলার অর্থাৎ একটি ট্রাকের ভাড়া ও ডিটেনশন চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। আবার সে ভাড়া পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ করে শুল্ক পরিশোধ করা হয়।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি ঔষধ শিল্পের ২ টন পণ্য আমদানি হয়েছে, যার ডিটেনশনসহ মালবাহী চার্জ ৩ হাজার ১০০ ডলার। অর্থাৎ একটি ট্রাকের ভাড়া ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। আবার একটি ইলেকট্রনিকস প্রতিষ্ঠানের নামে ১২০টি কেমিক্যাল চালানের ডিটেনশনসহ মালবাহী চার্জ ৩ হাজার ২০০ ডলার।

বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। ভারতের যে কোনো প্রদেশ হতে বেনাপোলে পণ্য আসলে সাধারণত ডিটেনশন ছাড়া দেড় লাখ টাকা ভাড়া হয় জানিয়ে মতিয়ার রহমান বলেন, পশ্চিম বাংলা সরকারের পরিবহন দফতর অনলাইনে  বুকিং চালু করায় ভারতের যেকোনো প্রদেশ হতে ট্রাক কলকাতায় এসে পৌঁছানোর পর ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে বেনাপোলে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে খুশি ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে উভয় দিকে সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে ভারতীয় পরিবহন দফতর, বন্দর কাস্টমস এবং বেনাপোল কাস্টমসও পোর্ট এলপিআই নিয়মিত তদারকি করলে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশে বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেটের ডিটেনশন হতে চিরতরে মুক্তি পাবে এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা উপকৃত হবে বলে আশা করেন তিনি।

বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক জানান, ৫ মাস আগে কালিতলা পার্কিংয়ের দায়িত্ব বনগাঁ পৌরসভা থেকে কেড়ে নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহন দফতর। তার সত্তে¡ও নানা জটিলতায় পরিপূর্ণ সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে গত ২৫ জুলাই অনলাইন এন্ট্রিতে ¯øট বুকিং সিস্টেম চালু করা হয়। এতে চলতি সপ্তাহে থেকে কালিতলা পার্কিংয়ে না দাঁড়িয়ে সরাসরি পণ্যবাহী ট্রাক পেট্রাপোল বন্দর হয়ে বেনাপোল বন্দরে ঢুকছে। এতে করে বাণিজ্যে গতিশীলতা ফিরেছে।

এবিষয়ে বেনাপোল স্থলবন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, দুই দেশের সরকারের উদ্যোগে কালিতলা পার্কিংয়ের সিন্ডিকেট থেকে ব্যবসায়ীদের মুক্তি মিলেছে। বিষয়টিকে একটি যুদ্ধ জয়ের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, সিরিয়ালের নামে আগে দেড় মাস পর্যন্ত ট্রাক আটকে রাখা হত। এখন ৩ দিনে বেনাপোল বন্দরে ট্রাক ঢুকছে।

আগস্ট ০২ ,২০২২ at ২০:২৯:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএম