চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ, মাদক কারবারি ও হত্যা মামলার আসামিদের কমিটিতে স্থান

পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান বা কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা দিয়ে অবরোধ করেন ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা। কমিটি পুনর্গঠনের দাবির এই বিক্ষোভে ক্যাম্পাসে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর বিতর্কিত দুই সদস্যের কমিটি তিন বছর পর পূর্ণাঙ্গ হয়ে আরো বিতর্ক সৃষ্টি করল। ৩৭৬ সদস্যের নতুন কমিটিতে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হত্যা মামলার আসামি, মাদক কারবারি, অছাত্র, বিবাহিত ও জেলা ছাত্রলীগ কমিটিতে পদধারীরাও স্থান পেয়েছেন। শতাধিক সদস্য ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকেও নানাভাবে পদ বাগিয়েছেন। পদ না পাওয়া ত্যাগী কর্মী ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া কর্মীরা ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করলে কমিটির সদস্য বাড়িয়ে চার শতাধিক করা হয়।

আরো পড়ুন:
বাবাকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে আটক
ভোলায় বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে গুলিতে গুরুতর আহত ছাত্রদল সভাপতি

চবির সাবেক ও বর্তমান একাধিক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, চার শতাধিক সদস্য নিয়ে কমিটি হলে সে কমিটির বেশি মূল্য থাকে না; যেখানে সহসভাপতিই শতাধিক। এই কমিটিতে অন্তত ১০০ জন পদ পেয়েছেন, যাঁরা ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে কখনোই সক্রিয় ছিলেন না। অনেকে পড়াশোনা শেষ করে কয়েক বছর ধরে চাকরি করছেন এবং বিবাহিত। তাঁরা কিভাবে এই কমিটিতে এলেন? এর পেছনে নিশ্চয়ই রুবেল-টিপুর ব্যক্তিস্বার্থ ও লেনদেন আছে। তাঁরা যাঁদের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের কমিটিতে রেখেছেন।

চবি ছাত্রলীগ মূলত দুই ধারায় বিভক্ত। একটি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজম নাছির উদ্দীনের অনুসারী এবং অন্যটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সমর্থক। এ দুই গ্রুপের ভেতরেই রয়েছে আবার বিভিন্ন নামে ১১টি উপগ্রুপ। বর্তমান সভাপতি রুবেল সিএফসি গ্রুপের নেতা এবং নওফেলের অনুসারী। সাধারণ সম্পাদক টিপু সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা এবং নাছিরের সমর্থক।

কমিটি নিয়ে জানতে চাইলে সদ্যোঘোষিত কমিটির সহসভাপতি ও নাছিরের অনুসারী ভিএক্স গ্রুপের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়, ক্যাম্পাসে আন্দোলন চলছে। আমরাও চাচ্ছি কমিটি ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে তার সমাধান হোক। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হোক। যদি সমাধান দেওয়া না হয়, আমরাও কাল-পরশু আন্দোলনের ডাক দিয়ে কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করব।

এদিকে নওফেলের অনুসারী বিজয় গ্রুপের নেতা ও নতুন কমিটির তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই কমিটি ছাত্রলীগের ফরম্যাটেই পড়েনি। ১০ জনের ওপর আছেন বিবাহিত, সিনিয়র-জুনিয়র মানা হয়নি। সিনিয়রদের অসম্মান করার জন্য এমনটা করা হয়েছে।

২০১ থেকে ৪০০ সদস্য, রুবেল-টিপু যখন বিভিন্ন গ্রুপের নেতাকর্মীদের নিয়ে সর্বশেষ মিটিং করেন, তখন তাঁরা ২০১ সদস্যের কমিটি করা হবে বলে জানান। তখন বিভিন্ন গ্রুপ থেকে সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সেশন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নাম দেওয়া হয়। পরে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কয়েক দফায় ঢাকায় গিয়ে তিন শর ওপরে নাম জমা দেন। এরপর কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সুপারিশসহ কমিটিতে চার শর বেশি সদস্য রাখা হয়। এতে ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীরাও জায়গা পান। ছাত্রলীগের ইতিহাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে এত বড় পরিসরে কোনো কমিটি ছিল না। এদিকে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ সেশনের যোগ্য অনেকে পদবঞ্চিত হয়েছেন।

কমিটি ঘোষণার পর যাঁদের ঘিরে বেশি বিতর্ক ও সমালোচনা হচ্ছে এবং ক্যাম্পাসে পরিচিত তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু মুন্সী, মোহাম্মদ ইলিয়াস ও শামীমা সীমা, সহসভাপতি ইফতেখার উদ্দিন আয়াজ, এস এম জাহেদুল আওয়াল প্রমুখ।

হত্যা মামলার আসামি রাজু মুন্সী ২০১৩ সালের ২৪ জুন রেলওয়ের কোটি টাকার দরপত্রের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি এলাকায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে মৃত্যু হয় দুজনের। সেই হত্যা মামলার আসামি রাজু মুন্সী। তিনি টিপুর অনুসারী। রাজুর নামে শিক্ষককে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগও আছে।

মাদক কারবারি মোহাম্মদ ইলিয়াস ক্যাম্পাসসহ অন্যত্র মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াসের বিরুদ্ধে। ইলিয়াসের বিজয় নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

শামীমা সীমা চবি পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের এই ছাত্রী চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সহসভাপতি। আবার চবির নতুন কমিটিতে যগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়েছেন। অথচ তাঁর সেশন ও আগের সেশনের ছাত্ররা পেয়েছেন উপসম্পাদকের পদ। মাত্র তিন বছরেই দুই কমিটির পদ নিয়ে বাজিমাত করেছেন তিনি। এ নিয়ে একাধিক কর্মীর ক্ষোভ রয়েছে।

চাকরিজীবী জাহেদুল চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা জাহেদুল আওয়াল এ কমিটিতে সহসভাপতি হয়েছেন। অথচ তিনি ক্যাম্পাসের পাট চুকিয়ে অনেক আগেই চাকরি নিয়েছেন।

ঠিকাদার ইফতেখার উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ঠিকাদারি কাজ করেন ইফতেখার উদ্দিন আয়াজ। ২০০৯-১০ সেশনের আয়াজের ছাত্রত্ব নেই। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থেকেও নতুন কমিটিতে সহসভাপতি হয়েছেন।

এ ছাড়া কমিটিতে সহসভাপতি পদে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের মো. আল আমিন রিমন, ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের নাসির উদ্দিন সুমন স্থান পেয়েছেন। সাইফুল ইসলাম, তারেক নিঝুম ও আব্দুল্লাহ আল রায়হান তিনজনই কয়েক বছর আগে ক্যাম্পাস থেকে চলে গেছেন। বর্তমানে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের চাকরি কিংবা ব্যবসা করছেন। নতুন কমিটিতে ছাত্রত্ব নেই, এমন অনন্ত ৩০ জন আছেন। বিভিন্ন মামলার আসামি রয়েছেন এক ডজনের বেশি। এদিকে সম্প্রতি ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন ও হেনস্তার অভিযোগে মেহেদী হাসান হৃদয় নামের এক ছাত্রকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। ওই ঘটনার কূলকিনারা না হলেও অভিযুক্ত হৃদয়ও পেয়েছেন পদ। ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই চবি ছাত্রলীগের দুই সদস্যের (রুবেল-টিপু) কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। অবশেষে নতুন এই কমিটি গঠন করা হয়।

বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। তবে সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু , এই কমিটিতে যাচাই-বাছাই করে যাঁরা যে পদের যোগ্য, সেভাবে রাখা হয়েছে। এর পরও যদি তাঁদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কেউ দেয়, সেটা তদন্ত করে সাংগঠনিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার কল দিলেও তাঁরা ফোন রিসিভ করেননি। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, চবি ছাত্রলীগের কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত, চাকরিজীবী কেউ থাকার অভিযোগ পেলে তাঁরা বিবেচনা করে দেখবেন।

আগস্ট ০২ ,২০২২ at ১৪:০৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দেপ্র/এসএম