ব্যাটারি রিকশায় বিদ্যুতের অপচয়

নগরজুড়ে বেড়েই চলেছে বিদ্যুতের অপচয়সহ লোডশেডিং। আর এ লোডশেডিংয়ের জন্য স্থানীয়রা ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইককে দায়ী করছেন বেশি। কারণ ওইসব যানবাহন চালাতে ব্যাটারি চার্জ দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এসব রিকশা চলাচল করছে অনেকটা নির্বিঘ্নে। যদিও পুলিশ বলছে, নগরীর প্রধান সড়কে এ ধরনের রিকশা দেখলেই আটক করা হচ্ছে। তবে অলিগলিতে ট্রাফিক পুলিশ না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু অবৈধ রিকশা চলছে। এ রিকশার বিপরীতে সরকার বা সিটি কর্পোরেশন কোনো ধরনের রাজস্ব পাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও প্রভাবশালীরা যোগসাজশে এসব রিকশা থেকে আদায় করছে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা বা মাসোহারা।

কিন্তু সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ অবৈধ রিকশা চলাচলের সঙ্গে পুলিশের কেউ জড়িত নেই দাবি করে আজাদীকে বলেন, প্রধান সড়কগুলোর যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ব্যস্ত থাকতে হয়। জনবল সংকটের কারণে অলিগলিতে সব সময় নজরদারি করা যায় না। এরপরও কোনো এলাকা থেকে অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই। রিকশা আটক করি অথবা জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দেই। পরদিন সেই রিকশা আবার রাস্তায় নামে। অবৈধ রিকশা মালিকদের সঙ্গে কোনো পুলিশ সদস্যের যোগসাজশের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান নগর পুলিশের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় অস্থির নগরবাসী। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ যতটুকু জুটছে, অবৈধ বিদুৎ সংযোগ তার একটি বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো অনুমোদনহীনভাবে নগরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। দিনকে দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সদ্য বিদায়ী সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর কড়া নির্দেশনা জারি করেছিলেন ১৬ থানার ওসিকে। তিনি বলেছিলেন, ১৬ থানা এলাকায় যদি একটি রিকশাও দেখা যায় তাহলে ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) সরাসরি জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি ওসিদের প্রতি তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল শুধু রিকশা জব্দ নয়, যেসব গ্যারেজে এসব রিকশা রাখা হয় ও ব্যাটারির চার্জ দেওয়া হয় সেসব গ্যারেজ মালিককেও আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু এরপরও নগরীর অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চলাচল নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। কিন্তু সেই নির্দেশের বাস্তবায়ন দেখার সৌভাগ্য হয়নি নগরবাসীর।

সরেজমিন গতকাল বৃহস্পতিবার ও গত বুধবার দেখা যায়, নগরীর জামালখান, চেরাগী পাহাড়, আন্দরকিল্লা, জেল রোড, পাথরঘাটা, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, চাক্তাই, আসকার দীঘির পাড়, চকবাজার ডিসি রোড, বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটা, বাকলিয়া সৈয়দ শাহ রোড, আবদুল লতিফ হাট, বহদ্দারহাট খাজা রোড, খতিবের হাট, মুরাদপুর-অঙিজেন রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোড, চান্দগাঁও সিএন্ডবি এলাকায় ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক চলছেই। প্রতিটি সড়কে গড়ে দশটি রিঙার মধ্যে অন্তত তিনটি রিকশা ব্যাটারি চালিত। নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডী নেই, চলছে নিজেদের ইচ্ছে মতো।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ধরনের অবৈধ যানবাহনে ছেয়ে গেছে শহর-বন্দর-গ্রামের হাটবাজারের অলিগলি। এসব অবৈধ যানবাহন ব্যাটারির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং সেই ব্যাটারি কয়েক ঘণ্টা পর পর চার্জ দিতে হয়। বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় প্রতিটি রিকশা গ্যারেজেই নিষিদ্ধ এসব ইজিবাইক ও রিকশার ব্যাটারি চার্জ করা হয়। সবগুলোতেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন।

চট্টগ্রাম ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক-মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে। সাধারণত একটি ইজিবাইক চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। প্রতিটি ব্যাটারি চার্জ দিতে দৈনিক খরচ হয় ৮ দশমিক ৭৫ ইউনিট। সে হিসেবে প্রতিদিন খরচ হয় ৮৭ হাজার ৫০০ ইউনিট বিদ্যুৎ। প্রতিদিন ৭০ টাকার বৈদ্যুতিক চার্জ দিতে হয় ব্যাটারি রিকশায়। বিপুল পরিমাণ এই বিদ্যুতের অনেকটাই অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয় বলে দাবি পিডিবির কর্মকর্তাদের। প্রতিটি রিকশা থেকে দিনে ৭০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এছাড়াও ব্যাটারি চার্জ ও গ্যারেজ ভাড়া নেওয়া হয় ১২০ টাকা করে।

বেশিরভাগ স্টেশনে রয়েছে পোস্ট পেইড মিটার। গুটিকয়েক প্রি-পেইড হলেও বাকি চার্জ স্টেশনগুলো বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে অবৈধ লাইন টেনে স্টেশন পরিচালনা করে আসছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মরত একশ্রেণির অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই সব অবৈধ সংযোগ দেন অর্থের বিনিময়ে। ফলে প্রতিদিন উৎপাদিত বিদ্যুতের একটা বড় অংশ গিলে খাচ্ছে এই ব্যাটারি রিকশা ও তিন চাকার ইজিবাইক।

নগরজুড়ে ইজিবাইক ও ব্যাটারি রিকশার চার্জ স্টেশন রয়েছে ২৮২টি। এর মধ্যে হালিশহর এলাকায় ৭৫টি চার্জ স্টেশন, চাঁন্দগাওয়ে ৫২টি, নতুন ব্রিজ এলাকায় ৩৫টি, পতেঙ্গায় ৩০টি, পাহাড়তলীতে ২৫টি, চকবাজারে ২৫টি, আকরবশাহে ২২টি, দেওয়ানহাটে ১৮টি চার্জ স্টেশন রয়েছে।

ব্যাটারি রিকশা চালকদের দেওয়া তথ্য মতে, সিরাজদ্দৌলা রোড থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত এলাকায় ২০/২৫ টি ব্যাটারি চার্জের গ্যারেজ খোলা হয়েছে। এর কোনটি বস্তির মধ্যে, কোনটি রাস্তার পাশের কোনো দোকানের পেছনে। একইভাবে ডিসি রোড বগার বিল, পাহাড়তলী লবন ফ্যাক্টরি মোড় জেলে পাড়া এলাকা, কর্নেলহাট এলাকায় এসব গাড়ির মালিকদের অনেকে ঘরের সংযোগ থেকে নিজের একাধিক গাড়ি চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন বলেও জানিয়েছেন চালকরা।

ইজিবাইক চালক মো. সেলিম মিয়া ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, যদি চালানোর অনুমতিই না দেবে, তবে বিক্রির অনুমতি দিল কেন? আমদানির অনুমতিইবা কেন দিল? এগুলোতো গরীবের সাথে তামাশা। তিনি বলেন, অনেক কষ্টে গাড়িটি কিনেছেন। কেনার পর থেকে তিনি নিজেই এটি চালিয়ে আসছেন। আগে যেখানে বাড়ির ব্যবহারিক বিদ্যুৎ বিল আসতো ৩০০ টাকার মতো। কিন্তু ইজি বাইকটি চার্জ দেওয়ায় প্রতি মাসে বিল আসছে ১৬শ থেকে ১৮শ টাকা।

জুলাই ২৮,২০২২ at ১১:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/দআ/রারি