মদের কনটেইনার : দেশের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে!

মিথ্যে ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কন্টেইনারভর্তি বিদেশি মদের চালান ধরা পরার পর চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস, র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগসহ সারাদেশেই তোলপাড় শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি স্থাপনার নানা কড়া নিরাপত্তা ধাপ এমনকি মেশিনের স্ক্যানিং পেরিয়ে কিভাবে একের পর এক কন্টেইনারভর্তি হাজার হাজার বোতল বিদেশি মদ বন্দরের বাইরে চলে গেল তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশ থেকে নানা পণ্যের আড়ালে শুধু যে মদই পাচার হয়েছে তা নয়। নিশ্চয়ই আরো অনেক মূল্যবান সামগ্রীও আমদানি করে দেশের ভেতরে পাচার করা হয়েছে- এমন সন্দেহও এখন অমূলক নয়। বন্দর-কাস্টমস কর্তৃপক্ষের এই যে ‘বজ্র আঁটুনি ফসকাগেরো’ অবস্থা তা গলিয়ে দেশের ভেতরে নাশকতা বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য অস্ত্র, বিস্ফোরকও আমদানি করে নির্বিঘেœ পাচার করে নিয়ে গেলেও কেউ হয়তো বলতে পারেনি বা পারবে না। জাল-জালিয়াতির এই চক্রের সঙ্গে শুধু কী অসাধু-মুনাফাখোর ব্যবসায়ী চক্র জড়িত নাকি দেশি-বিদেশি কোনো শক্তিশালী চক্র গভীর কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে- সে বিষয়টিও গভীরভাবে তদন্তের দাবি রাখে। কারণ এমন ‘ঢিলেঢালা চেকিং’-এর ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও যে হুমকির মুখে পড়বে না তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে মিথ্যা ঘোষণা এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে শুল্কফাঁকি দেয়া চক্র ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ভুয়া ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) ব্যবহার করে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা পণ্যের নামে অন্য পণ্য নিয়ে আসছে। গত তিন দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতর থেকে এবং বন্দর থেকে খালাস হওয়া ৫টি বিদেশি মদের চালান আটক হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) সিএফএস শেডে দুই কন্টেইনার মদের চালান আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টমস।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানিসহ জাল-জালিয়াতি করছে সিন্ডিকেট চক্র। পণ্যমূল্য ফাঁকি, পণ্যের গুণগত মান নিয়ে জালিয়াতি, পরিমাণ ও ওজনে কম দেখানো এবং পণ্যের এইচএস কোড জালিয়াতি- এই চার প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। নানা উদ্যোগের পরও দমানো যাচ্ছে না মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির প্রবণতা। নানা ছলচাতুরি ও নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে জালিয়াত চক্র এক রকম পণ্যের ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য। সম্পূর্ণ বিনাশুল্কের পণ্য অথবা কম শুল্কের পণ্যের আড়ালেও কৌশলে নিয়ে আসে উচ্চশুল্কের পণ্য। একইসঙ্গে আসে বৈধ পণ্যের আড়ালে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত পণ্যও। এসব চালানের আড়ালে শত শত কোটি টাকার সরকারি রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে জালিয়াতি চক্র।

এদিকে তিন দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা বিদেশি মদের বড় ৫টি চালান উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ৫টি চালানই আইপি জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করা হচ্ছিল। এর মধ্যে দুটি চালান বন্দর থেকে খালাস করে নেয়া হয়। আর ৩টি খালাসের আগেই ধরা পড়ল। এ জাল-জালিয়াতির সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউস এবং সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের অসাধু কিছু কর্মচারী জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ তাদের যোগসাজশেই এসব হচ্ছে। আর তা না হলে এত ঘাট পার হয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে দুটি কন্টেইনার বের করে নেয়া কখনোই সম্ভব হতো না। ভুয়া ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরে এসব মদের চালান আমদানি করা হয়েছিল সুতা ও মেশিনারি পণ্য ঘোষণা দিয়ে। শুধু তাই নয়, বন্দর থেকে এ চালান বের করা পর্যন্ত সব ধাপেই নেয়া হয়েছিল জালিয়াতির আশ্রয়। বিষয়টি জানাজানির পর টনক নড়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের এআইআর শাখার ডেপুটি কমিশনার সাইফুল হক বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় এবং ভুয়া আইপি ব্যবহার করে মদ আমদানি করা হয়। বন্দর থেকেও এ চালান বের করা হয়েছিল নানা জালিয়াতির মাধ্যমে। এগুলো স্ক্যানিংযোগ্য পণ্য। অথচ স্ক্যানিং না করেই ভুয়া স্ক্যানিং পেপার জমা দিয়েছিল। স্ক্যানিং পেপারে কাস্টমস কর্মকর্তার ভুয়া স্বাক্ষর ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি কোনো সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের কাজ। এ ঘটনা তদন্তে কাস্টমস কমিশনারের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

আরো পড়ুন :
শিক্ষার্থীকে হত্যা: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ভুয়া আইপি ব্যবহার করে এসব মদ আমদানি করা হয়। এসব চালানের আইপি আইডি যাচাই করে দেখা যায়, ওই আইপি জাল। ভুয়া আইপি ব্যবহার সত্ত্বেও কিভাবে শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, স্ক্যানিং ও গেট ফাঁকি দিয়ে কিভাবে পণ্য চালান দুটি খালাস হলো এসব বিষয় তদন্ত করে দেখা হবে।’

শুল্ক ফাঁকি দিতে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমাদনির পাশাপাশি জালিয়াতির মাধ্যমে বন্দর থেকে পণ্য বের করে নেয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। তবে সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কঠোর নজরদারির কারণে জালিয়াত চক্রটি কিছুটা কোণঠাসা হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মিথ্যা ঘোষণার বড় চালান ধরা পড়ে। যন্ত্রাংশ ও সুতার নামে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মূল্যবান মদের বিশাল চালান আমদানির ঘটনায় জালিয়াত চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা জানান, এ ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে বন্দর ও কাস্টম হাউসের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গতকাল সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে খালাসের পর বিদেশি মদের আরও দুটি চালান আটক হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) সিএফএস শেডে মদের দুটি পৃথক চালান বোঝাই কন্টেইনারটি আটক করা হয়। এ নিয়ে তিন দফায় বন্দরে খালাস হওয়া ৫টি বিদেশি মদের চালান আটক করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সোমবার আটক করা আরেকটি চালান এসেছে বাগেরহাটের মোংলা ইপিজেডের ভিআইপি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের নামে। টেক্সটাইল সুতা আমদানির ঘোষণা দিয়ে চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের এআইআর শাখার উপকমিশনার সাইফুল হক জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমসের অডিট, ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিচার্স (এআইআর) ও পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট (পিসিইউ) শাখার কর্মকর্তারা কন্টেইনারটি খুলে মিথ্যা ঘোষণায় আনা বিদেশি মদ পেয়ে সেগুলোর খালাস বন্ধ ঘোষণা করেন। চালান দুটির মধ্যে একটি এসেছে নীলফামারির উত্তরা ইপিজেডের ডঙ জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) লিমিটেডের নামে। ওই চালানে সিনথেটিক প্লাস্টিকজাত পণ্য তৈরির কাঁচামাল পলিপ্রপিলিন রেজিন আমদানির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। একই প্রতিষ্ঠানের নামে আনা আরেকটি মদের চালান রবিবার কাস্টমসের এআইআর শাখার কর্মকর্তারা বন্দরের ৫ নম্বর ইয়ার্ডের ১৩ নম্বর শেডে অভিযান চালিয়ে আটক করেছিল। কাস্টমস কর্মকর্তা সাইফুল আরো জানান, সর্বশেষ আটক দুটি চালান খালাসের জন্য কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়নি। এজন্য খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে, রবিবার আটক করা কন্টেইনারটি খালাসের দায়িত্বে ছিল নগরীর ডবলমুরিংয়ের জাফর আহমদ নামে একজনের মালিকানাধীন সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। একই সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিদেশি মদের দুটি চালান খালাস করে নিয়ে যায়। শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা মদের চালান দুটি আটক করেন। কুমিল্লা ইপিজেডের হাসি টাইগার কোম্পানি লিমিটেড মেশিনারি এবং পাবনার ঈশ্বরদীর বিকেএইচ টেক্সটাইল লিমিটেডের নামে সেলাই মেশিনের ববিন ঘোষণা দিয়ে চালান দুটি আমদানি করা হয়েছিল। শতভাগ পরীক্ষায় পণ্য চালান দুটিতে ১ হাজার ৩৩০ কার্টনে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩১ হাজার ৬২৫ দশমিক ৫ লিটার বিদেশি মদ পাওয়া যায়। পণ্য চালান দুটিতে মিথ্যা ঘোষণায় ২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা হয়েছে। গত দুদিনে আটক ৩টি চালানে বিদেশি মদের পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে বলে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জুন ২৬,২০২২ at ১০:৫৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভক/এমএইচ