শিল্পমন্ত্রী বান্ধবীসহ গ্রেপ্তার : ২১ কোটি টাকা উদ্ধার

পরীক্ষায় পাস করে চাকরি না পাওয়া শতাধিক তরুণ-তরুণীর আন্দোলনে নড়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। বড় চাপে পড়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। সেখানকার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমানে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অভিনেত্রী-মডেল অর্পিতার বাড়ি থেকে ২১ কোটি টাকাসহ বিপুল সম্পত্তি উদ্ধারের পরই এই জল্পনা শুরু হয়েছে- ভেঙে যেতে পারে মন্ত্রিসভা।

কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে অর্থ কেলেঙ্কারিবিষয়ক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের (ইডি) প্রথম অভিযানে অর্পিতার বাড়িতে পাওয়া যায় নগদ ২১ কোটি টাকার বেশি। গ্রেপ্তার হন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জি ছাড়াও পার্থর ব্যক্তিগত সচিব সুকান্ত আচার্য।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দুই দিনের হেফাজতে নিয়েছে ইডি। এ ঘটনায় বিজেপি তৃণমূলকে বলেছে ‘আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ’। অপরদিকে তৃণমূল বলেছে, যার বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হয়েছে তিনি তৃণমূলের কেউ নন। আর বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে মন্ত্রী পার্থর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার সাতসকালে পশ্চিমবঙ্গের ‘স্কুল সার্ভিস কমিশন’ (এসএসসি) নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির কর্মকর্তারা রাজ্যের ১৪টির বেশি জায়গায় অভিযান চালান।

যার মধ্যে অন্যতম সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। এদিন সকালেই পার্থর দক্ষিণ কলকাতার নাকতলার বাড়িতে যান ইডির কর্মকর্তারা। তার বাড়ি গিয়েই মন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীর মোবাইল ফোন নিয়ে নেন তারা।

এরপর পার্থকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে শনিবার সকাল পর্যন্ত চলে সেই জিজ্ঞাসাবাদ। এদিকে পার্থর বাড়িতে যখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ঠিক সে সময় পার্থর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখার্জির বাড়ি থেকে নগদ ২০ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। সঙ্গে ৫০ লাখ টাকার বিদেশি মুদ্রা ও ৮০ লাখ টাকার বিদেশি গহনা। উদ্ধারকৃত ওই টাকা মধ্যে রয়েছে বান্ডিলে বাঁধা ২০০০ ও ৫০০ টাকার নোট।

এদিন রাতে অর্পিতার টালিগঞ্জের ডায়মন্ড সাউথ সিটি বহুতল আবাসন থেকে উদ্ধার হয় ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ। জানা গেছে, এই অর্পিতা বেশ কিছু সিনেমায় ও সিরিয়ালে অভিনয় এবং মডেলিং করেছিলেন।

ইডির প্রাথমিক তালিকায় অর্পিতার নাম ছিল না বলেই জানা যায়। পরে তদন্ত করতে গিয়ে তার নাম উঠে আসে। শুক্রবার রাতে যখন তার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়, সে সময় সব ঘর খোলা থাকলেও একটি ঘরে তালা বন্ধ ছিল। তা দেখে সন্দেহ হয় ইডির কর্মকর্তাদের। পরে ওই ঘরের দরজা খুলতেই চোখ কপালে উঠে তাদের। মিলে দুটি বস্তাভর্তি টাকা।

এরপরই তাকে জেরা করেন ইডির কর্মকর্তারা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে এলো, ২০টি মোবাইল কী কাজে ব্যবহার করা হতো, ওই বহুতল আবাসনে অর্পিতার আর কোনো ফ্ল্যাট আছে কিনা তাও দেখা হচ্ছে। ওই টাকার বিষয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিছু জানেন কিনা তা জানা হচ্ছে। পরে ইডির তরফ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের ছবিসহ টুইট করা হয়।

সেখানে লেখা হয়, ‘পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে এসএসসির মাধ্যমে নবম ও দশম শ্রেণিতে শিক্ষক, গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি পদে নিয়োগ মামলায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ। এই আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীনই। দুর্নীতির অভিযোগ আসার পরই কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার হাতে নেয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।

তারা মূলত এ মামলার ফৌজদারির দিকটি দেখছে। কাদের হাত ধরে এই দুর্নীতি হয়েছে তা খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছেন সিবিআইর তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক পরেশ অধিকারী, তৃণমূল বিধায়ক ও পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সাবেক সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সচিব সুকান্ত আচার্য, তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা পি কে বন্দোপাধ্যায়, পার্থের আত্মীয় কল্যাণময় ভট্টাচার্য, এসএসসির সাবেক উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সাবেক সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, স্কুলশিক্ষা দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর অলোক কুমার সরকার, পর্ষদ সচিব রত্ন চক্রবর্তী বাগচী, সাবেক পার্শ্ব শিক্ষক চন্দন মণ্ডলের মতো অভিযুক্তদের বাড়িতেও অভিযান চালায় ইডি।

এর আগেও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কয়েক দফায় জেরা করেছে সিবিআই। ইতোমধ্যেই এই দুর্নীতির মামলায় নাম জড়িয়েছেন পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীরও। অভিযোগ, মেরিট লিস্টে নাম না থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র টাকার জোরে চাকরি পান অঙ্কিতা। পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে শিক্ষকতার চাকরি যায় অর্পিতার। শুধু তাই নয়, স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে গত কয়েক বছর ধরে যে বেতন পেয়েছিলেন তাও দুই কিস্তিতে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে ফেরত দিতে নির্দেশ দেন আদালত।

তদন্তে উঠে এসেছে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পত্তির হিসাব। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরে স্ত্রী বাবলি চট্টোপাধ্যায়ের নামে স্কুল। যার আনুমানিক খরচ ৪৫ কোটি। শান্তিনিকেতনে ৭টি বাংলো। বোলপুরে ৪ হাজার বর্গফুট ফ্ল্যাট- আনুমানিক দাম ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জির বাড়ি থেকে মিলেছে নগদ প্রায় ২০ কোটি টাকা। সোনা ৭০ লাখ টাকার। ডলার ৫০ লাখ ও বেলঘরিয়ায় ২টি ফ্ল্যাট।

আরেক বান্ধবী মোনালিসা দাসের রয়েছে শান্তিনিকেতনে ১০টি প্লট। এছাড়া বেশ কয়েকটি জমির দলিল। আরো সম্পত্তি ও অর্থের খোঁজ পেতে কলকাতার ব্যাঙ্কশাল আদালত থেকে পার্থকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ইডি।

এদিকে মন্ত্রী গ্রেপ্তারের পর চাপে পড়েছে রাজ্যে ক্ষমতাসীন টিএমসি। দলটির গায়ে কাদা মাখাতে কম চেষ্টা করছে না বিরোধী বিজেপি। দলটির সাংসদ সৌমিত্র খান গতকাল শনিবার বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন চোর। তিনি দাবি করেছেন, সব টিএমসি নেতার একাধিক বান্ধবী রয়েছে এবং তারা বড় আকারের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস চোরের দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। খান বলেন, ফিরহাদ হাকিম এবং অভিষেক ব্যানার্জির মতো অন্য সিনিয়র নেতাদের পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি টিএমসি প্রধানকে ‘ডাকাতের রানী’ বলেও অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেন, আজ পার্থকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আগামীকাল ফিরহাদ হাকিমকে গ্রেপ্তার করা হবে। তারপর অভিষেক ব্যানার্জিকে গ্রেপ্তার করা হবে। এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। ভারতের সব নেতা- যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেন, আমি তাদের অনুরোধ করছি- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন চোর। তাকে কখনই বিশ্বাস করবেন না।

বিজেপি সাংসদ আরো বলেন, তার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে ৫০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েছেন মহাফ্যাসাদে।

২১ জুলাই শহীদ দিবসের মঞ্চ থেকে বিজেপিকে আক্রমণ করে মমতা বলেছিলেন, বিজেপি কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে টিএমসি নেতাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। এখন টিএমসি একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে, অর্পিতার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

এমনকি দলের কোনো নেতা তাকে চেনেন না বলেও জানানো হয়। এই বক্তব্যের পর বিজেপি তৃণমূল নেতাদের আক্রমণ করেছে। বিজেপি মুখপাত্র একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন, যাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অর্পিতার সঙ্গে দেখা যায়।

বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে, এই সম্পর্ককে কী বলে? একই সময়ে, বিজেপি নেত্রী অগ্নি মিত্রা পল মিত্র দাবি করেন, পার্থর বান্ধবী অর্পিতা। বিজেপির মুখপাত্র শাহজাদ পুনাওয়ালা একটি পুরনো ভিডিও টুইট করেছেন। এই ভিডিওতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে একই প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে।

যেখানে মমতাকে অর্পিতার প্রশংসা করতে শোনা যাচ্ছে, অর্পিতা তাকে হাতজোড় করে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। শাহজাদ আরো বলেন, যে দুর্নীতি হয়েছে তা এক বা দুই ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়। এটা পুরো তৃণমূলের যোগসাজশ। গরিবদের চাকরি ধনীদের কাছে বিক্রি করার কেলেঙ্কারি। টিএমসিকে উত্তর দিতে হবে। পার্থ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং টিএমসির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অনেক ছবি রয়েছে। একুশ কোটি টাকা সামান্য, ২১ হাজার কোটি টাকারও বেশি দুর্নীতি হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সাবেক সভাপতি ও সাংসদ দিলীপ ঘোষ বলেছেন, তদন্ত পৌঁছে যাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বিজেপি সাংসদ বলেন, গ্রেপ্তারটা আরো আগেই হওয়া উচিত ছিল। আরো অনেককে গ্রেপ্তার করতে হবে। দেড়শ কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়েছেন জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল।

বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পল বলেন, বাংলা খুশি। কয়েক দিন আগে আদালত বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে হবে কিন্তু মমতা আদালতের নির্দেশও মানেননি। আমরা এখনো হুমকি পাচ্ছি, যদি কিছু হয় …। পুরো দল উপর থেকে নিচ পর্যন্ত টাকা খেয়েছে।

তবে এই ইস্যুতে তৃণমূলের দুই গ্রুপের মধ্যে চলা ঠাণ্ডা যুদ্ধ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। প্রথম দলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পরিবহনমন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের মতো দলের পুরনো রক্ষীরা রয়েছে। দ্বিতীয় দলটিকে অপেক্ষাকৃত ছোট অংশ বলা হয় যেটি মমতার ভাইপো, তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং লোকসভা সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠরা।

তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের বাঁচাতে প্রচার শুরু করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তদন্তের পেছনে রয়েছে। যদিও বাস্তব ঘটনা হলো, ইডির অর্থ পাচারের মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট।

জুলাই ২৪,২০২২ at ১১:৪৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/আবা/আক