এডিসি লাবণী ও তার সাবেক ব্যক্তিগত দেহরক্ষী কনস্টেবল হাসানের আত্মহননে ধূম্রজাল

মাগুরায় এক নারী পুলিশ কর্মকর্তার পর পুরুষ কনস্টেবলের আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সাবেক দুই সহকর্মীর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও। নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে মাগুরাসহ দেশজুড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সংশ্লিষ্টরা। দুজনেরই ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেট ফরেনসিকের জন্য নেয়া হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা, তবে বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে।

আত্মঘাতী খন্দকার লাবণী ৩০তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি খুলনা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মাহমুদুল হাসান দুই বছর চার মাস আগে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। দেড় মাস আগে মাগুরা পুলিশ লাইন্সে বদলির আগে খন্দকার লাবণীর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।

পরিবার ও স্বজনরা জানিয়েছে, পারিবারিক জীবনে অসুখী ছিলেন পুলিশের এডিসি খন্দকার লাবণী। ক্যান্সারে আক্রান্ত তার স্বামী তারেক আবদুল্লাহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক (এডি) হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে চিকিৎসাজনিত কারণে ভারতে রয়েছেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না দুই সন্তানের এ জননীর। এর আগেও গত জুন মাসের শুরুতে লাবণী দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।

খন্দকার লাবণীর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার শফিকুল আজম জানান, গত ১৭ জুলাই এক সপ্তাহের ছুটিতে লাবণী গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। গত বুধবার লাবণী শ্রীপুর ইউনিয়নের সারঙ্গদিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে অবস্থান করছিল। গভীর রাতে সে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে। কেন বা কী কারণে এ আত্মহত্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে লাবণীর সঙ্গে তার স্বামীর কলহ চলছিল। সংসারে আমার মেয়ে সুখী ছিল না। মূলত সাংসারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বামীর সঙ্গে লাবণীর বনিবনা হচ্ছিল না। এ কারণেই আমার মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এর আগে গত জুন মাসের শুরুতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ও গলায় বেল্ট পেঁচিয়ে দুবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।

লাবণীর আত্মহত্যার কয়েক ঘণ্টা পর গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে মাগুরা পুলিশ লাইন্সের ব্যারাকের চার তলা ভবনের ছাদে নিজের কাছে থাকা শর্টগানের গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন কনস্টেবল মাহমুদুল হাসান। নিহত মাহমুদুল হাসান কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা সদরের এজাজুল হকের ছেলে।

আত্মহত্যাকারী পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে খন্দকার লাবণীর অন্য কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা- জানতে চাইলে খন্দকার শফিকুল আজম বলেন, এ রকম কোনো বিষয় আমরা এখন পর্যন্ত শুনিনি। এদিকে কনস্টেবল মাহমুদুল হাসানের বাবা মো. এজাজুল হক খান চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। গতকাল তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, দুই বছর চার মাস আগে আমার ছেলে পুলিশে যোগ দেয়। দেড় মাস আগে মাগুরায় আসার আগে সে খুলনা গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিল। গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মুঠোফোনে ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। সে জানায়, যশোর রোডে ডিউটিতে আছে। তার সঙ্গে স্বাভাবিক ও হাসি-ঠাট্টামূলক কথা হয়। কিন্তু কী কারণে সে আত্মহত্যা করেছে, সেটা বুঝতে পারছি না।

পুলিশ কর্মকর্তা খন্দকার লাবণীর সঙ্গে শ্যালকের কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা? সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে না পারলেও কনস্টেবল মাহমুদুল হাসানের ভগ্নিপতি মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, শ্যালক মাঝে মাঝে বলত, খুলনায় তার চাকরি করতে ভালো লাগছে না। তার অন্যত্র বদলি হওয়া প্রয়োজন। সে কারণেই মাহমুদুল বদলি হয়ে মাস দেড়েক আগে মাগুরায় আসে।

খুলনা বিভাগীয় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তদন্ত চলছে। শিগগিরই আসল রহস্য জানা যাবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে রাষ্ট্রীয়, কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক তিন অবস্থাতেই পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তবে বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেই যায়। ফলে পুলিশ সদস্যরা মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে থাকে, যাকে আমরা মেন্টাল হ্যাজার্ড বলে থাকি।

তিনি বলেন, তরুণ পুলিশ কনস্টেবল নারী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিলেন। আভিযানিক কাজ থেকে শুরু বাসায় পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত অধিকাংশ সময়ই দুজন এক সঙ্গেই থেকেছেন। যেহেতু এ নারী কর্মকর্তা সাংসারিক জীবনে অসুখী ছিলেন। তাই দুজনের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়েও উঠতে পারে। কিন্তু এখন দেখতে হবে তাদের মধ্যে আসলে কী সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ নাকি প্রেম বা চাহিদা সংশ্লিষ্ট কিছু ছিল।

ref: bhorerkagoj