ফেসবুকে কতিপয় ‘সাংবাদিকের’ বিরক্তিকর ট্যাগবাজি

এস আর সেলিম

একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরের ফেসবুক টাইমলাইন পুরোটা ঘুরে দেখা গেল, সেখানে অতিউৎসাহী এক জুনিয়রের ট্যাগপোস্ট ছাড়া আর তেমন কিছুই নাই। নয় মাস আগে খোলা ফেসবুক অ্যাকাউন্টটির যাত্রাই শুরু হয়েছে ওই ট্যাগপোস্টের মাধ্যমে। কোনো জাতীয় দৈনিকে স্থানীয় দৈনিকের মতো সব খবর ছাপা হয় তা ট্যাগপোস্ট করা ওই দৈনিকটির ই-পেপার আদলের ‘নিউজ কাটিং’ না দেখলে কারোরই বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে কতিপয় ‘সাংবাদিকের’ এই বিরক্তিকর ট্যাগবাজির প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারো অনুমতি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছাখুশিমতো সমানে ট্যাগ করে যাচ্ছেন তারা। নিজেদের ফেসবুক টাইমলাইনকে তারা ড্রয়িংরুম, বেডরুম এমনকি কখনো আবার বাথরুমের মতো করে ব্যবহার করছেন, যা ট্যাগপোস্টে যুক্ত করে অন্যদের টাইমলাইনও ভরে দিয়ে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।

অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও একটু বলি, প্রথম আলোর জেলাভিত্তিক পৃষ্ঠা রয়েছে। তারা কয়েকটি জেলা মিলে পুরো এক পৃষ্ঠা করে কয়েক পৃষ্ঠা জেলার খবর প্রকাশ করে। এ জন্য তাদের আলাদা সংস্করণ করতে হয়। এক বছর আগে বাজারে আসা বিগ বাজেটের দৈনিক আজকের পত্রিকা প্রথম আলোর পথ ধরে তারাও প্রায় একইভাবে জেলাভিত্তিক পৃৃষ্ঠা রেখে খবর ছাপছে। তাদের মূলপ্রতিপাদ্যই হচ্ছে, ‘সারাদেশের স্থানীয় দৈনিক।’ যার প্রতিফলনও ঘটিয়েছে ১২ পৃষ্ঠার ওই দৈনিকটি। আজকের পত্রিকার উদ্বোধন সংখ্যার লিড নিউজ নিয়ে সচেতন পাঠকদের মধ্যে হতাশাজনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও মাত্র এক বছরেই সার্কুলেশনে বেশ ভালো সফলতা পেয়েছে তারা। কয়েকটি দৈনিকে খুলনা বিভাগের দশ জেলার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জেলা যশোরের খবর প্রকাশের জন্য পুরো এক পৃষ্ঠাই বরাদ্দ রয়েছে। যদিও এই দৈনিকগুলো কয়েকটি সংস্করণ হওয়ায় নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে অন্য জেলায় সেই খবর পাওয়া যায় না। অর্থাৎ পদ্মার ওপারে পাশের জেলা পাবনার খবর কুষ্টিয়া জেলায় আসা পত্রিকায় থাকে না। কারণ পাবনা হচ্ছে, আলাদা বিভাগ রাজশাহীর একটি জেলা। এভাবেই সংস্করণ করে পত্রিকাগুলো অঞ্চলভিত্তিক খবর প্রকাশ করে আসছে।

নব্বইয়ের দশকে দেশে আধুনিক সংবাদপত্রে নতুন এক বিপ্লব ঘটায় দৈনিক জনকণ্ঠ। সর্বপ্রথম তারাই একসঙ্গে খুব সম্ভবত চারটি অঞ্চল থেকে প্রকাশনা শুরু করে। সাতসকালে সবার আগে পাঠকদের হাতে পত্রিকা তুলে দেয়ার মাধ্যমে শুরুতেই জনকণ্ঠ ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। হু হু করে তাদের পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছিল, উঠে এসেছিল প্রচারসংখ্যার শীর্ষে। তবে জনকণ্ঠ এখন তাদের সেই অবস্থান ধরে রাখতে না পারলেও তারাও শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকগুলোর একটি। জনকণ্ঠের যাত্রা শুরুর পর একই উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোয় নগর সংস্করণ থেকে শুরু করে একাধিক সংস্করণ বের হতে থাকে। কে কার আগে সারাদেশে দৈনিক পত্রিকা পৌঁছাবে সেই যুদ্ধ শুরু হয়। এর সুবাদে রাজধানীর মতো মফস্বলের পাঠকরাও সকালে ঘুম থেকে উঠে জাতীয় দৈনিকে চোখ রাখার সুযোগ পান।

অন্যদিকে স্বল্পমূল্যে মার্কেটিংয়ের নতুন পলিসি নিয়ে বের হয় দৈনিক নয়াদিগন্ত। মাত্র পাঁচ টাকা মূল্যের ১৬ পৃষ্ঠার ওই পত্রিকাটি প্রথমের দিকে মোটামুটি একটা জায়গা দখল করতে সক্ষম হলেও পরে দফায় দফায় মূল্য বাড়ানোয় ধীরে ধীরে চাহিদা কমতে শুরু করে। ডিএফপির তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে নয়াদিগন্তের সার্কুলেশন প্রায় তলানির দিকে। তবে প্রায় একই পলিসি নিয়ে বাজারে আসা বাংলাদেশ প্রতিদিন আত্মপ্রকাশের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথম আলোর মতো দৈনিককে ডিঙিয়ে সার্কুলেশনের শীর্ষ অবস্থান দখল করে নেয়। এখনো তারা শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। কেউ কেউ আবার বিশাল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেও টিকে থাকতে পারেননি, লোকসানের মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বন্ধ হয়ে যাওয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে, র‍্যাংগস গ্রুপের দৈনিক সকালের খবর। তারা ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশনা শুরু করেছিল। এ রকম ভাঙাগড়ার বাস্তবতায় শুরুতেই যেই দৈনিকটির কথা উল্লেখ করলাম সেটাসহ বাহারি নামে প্রকাশিত আরো কয়েকটি স্বল্প পৃষ্ঠার জাতীয় দৈনিকে সংস্করণ ছাড়াই বর্তমানে স্থানীয় খবর এত বেশি মাত্রায় ছাপা হচ্ছে, যা বেশকিছু স্থানীয় দৈনিককেও হার মানাচ্ছে। তবে সঙ্গত কারণেই নামসর্বস্ব, মানহীন এসব জাতীয় দৈনিক পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্থানীয় খবরকে প্রাধান্য দেয়া এই জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রতিনিধিরা যেভাবে ভুলভাল খবর লিখে পাঠান কোনো রকম সম্পাদনা ছাড়াই হুবহু সেভাবেই প্রকাশ করা হয়। হয়তো তাদের লোকবল সংকটের কারণেও এ রকম হতে পারে। বেতন দিয়ে লোক রাখার মুরোদ নাই কিন্তু দৈনিক পত্রিকার ‘সম্পাদক’ হওয়ার খায়েশ রয়েছে, এমন কিছু ব্যক্তির জন্যই বেশ কিছুসংখ্যক অখ্যাত জাতীয় দৈনিক আঞ্চলিক ও স্থানীয় দৈনিকের মতো অাবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় দৈনিকের চাইতেও বাজেভাবে প্রকাশ হচ্ছে। ফলে এসব তথাকথিত জাতীয় দৈনিকের জন্মদাতাদের উদ্দেশ্য কী খুব সাধারণভাবে দেখলেই তা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মূলত টাকা কামানোর মেশিন হিসাবে নামসর্বস্ব এসব পত্রিকাকে কাজে লাগানো হয়। তারা সরকারের আনুকূল্য লাভের জন্য সারাক্ষণ গুণগান করতে থাকেন। আর এই কাজের জন্য সারাদেশে প্রতিনিধিদেরও ব্যবহার করা হয়। এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে অনেক কথাই চলে আসে, বহুবার বলেছি। এখন আবার নতুন করে বলার ইচ্ছা নাই। শুধু এটুকুই বলবো, ফেসবুকে বিশাল ট্যাগের বহর সংবলিত যাচ্ছেতাই পোস্ট দিয়ে হয়তো স্থানীয়ভাবে কিছুটা বিজ্ঞাপিত হওয়া যাবে, কিছুটা ফায়দাও লুটে নেয়া যাবে। যদিও এটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু অখ্যাত ওই জাতীয় দৈনিকগুলো একটা সময় নিশ্চিতভাবেই হারিয়ে যাবে, আবার কিছু নতুন করেও জন্মাবে।

অপরদিকে কোনোরকম লোকবল ছাড়াই কেবলমাত্র কম্পিউটার অপারেটর কাম পেস্টারকে দিয়ে একটা ‘পত্রিকার’ বডি তৈরি করে শুধু লোগো বদল করেও একাধিক ‘পত্রিকা’ প্রকাশ করা হয়। যা অান্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা হিসাবে পরিচিত। এক শ্রেণির ব্যক্তিরা ডিএফপির চোখ ফাঁকি দিয়ে যুগের পর যুগ ধরে অান্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা চালিয়ে আসছেন। আমার মতে, নামসর্বস্ব জাতীয় পত্রিকাগুলো আর পেস্টারনির্ভর আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। বরং অান্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা হলেও তারা যুগের পর যুগ টিকে আছে এবং টিকেও থাকবে। কিন্তু নামসর্বস্ব আনাড়ি জাতীয় পত্রিকাগুলো ব্যাপক হাঁকডাক করে দলবাজি, তেলবাজিতে জড়িত হয়ে ফায়দা লুটে নিলেও ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। পত্রিকা প্রকাশনার নিয়মনীতি মেনে চলা প্রথম আলো, আজকের পত্রিকাসহ স্থানীয় খবরকে প্রাধান্য দেয়া অপরাপর মূলধারার দৈনিকগুলোকে হয়তো কখনোই পেছন ফিরে তাকাতে হবে না, তারা নিজস্বগতিতেই এগিয়ে যাবে আরো সামনের দিকে। তবে কাগজে-কলমে নয়, সত্যিকার অর্থেই শীর্ষদশের তালিকায় কোন দৈনিক কত নম্বরে থাকবে সেটা নির্ভর করবে তাদের দৃঢ়তা ও সক্ষমতার ওপর।

যা বলছিলাম, স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর আর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের ফেসবুক ওয়ালে কতিপয় ‘সাংবাদিকের’ দেয়া ট্যাগের বহর অনেক বড় দেখা যায়। এত কেনরে ভাই। জানি তো, তেলমারার জন্যই ট্যাগকেও কার্যকর পদ্ধতি মনে করেন। কিন্তু তেলবাজির এই পদ্ধতি ট্যাগে যুক্ত করা সবাই পছন্দ করেন কিনা সেটাও মাথায় রাখা দরকার। আপনারা যারা বিরক্তিকর ট্যাগবাজি করেন তারা ট্যাগপোস্টের এই ছোটলোকিপনা থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন না। তাই পরামর্শ হলো, গণহারে ৯০-৯৫ জনকে না করে আপনাদের পোস্টগুলো খবর সংশ্লিষ্ট দুয়েকজন ঊর্ধ্বতনকে ট্যাগ করতে পারেন। তবে ট্যাগ করা থেকে বিরত থাকতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। যদিও তা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনাদের এই ট্যাগবাজি কার্যত তেলবাজিরই অংশ। যতখুশি তেলবাজি করেন সমস্যা নাই। কিন্তু তা যেন মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। আপনারা যাদের ট্যাগ করে থাকেন তারা নিশ্চয় আপনাদের ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন। আপনারা একটা কিছু পোস্ট করলে এমনিতেই তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। যার যেটা প্রয়োজন হবে তিনি সেটা নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করে নিতে পারবেন। অথবা আপনাদের (যারা ট্যাগ করেন) কাছে ট্যাগ রিকোয়েস্ট পাঠালে তখন অ্যাড করে নেবেন, এটাই তো যথেষ্ট।

তবে মানবিক কোনো পোস্টে ট্যাগের মাত্রা বাড়ানো হলে সেটা খুব একটা বাড়াবাড়ির মধ্যে পড়ে না। কেননা, সেইসব পোস্টে ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার স্যাপার থাকে না বললেই চলে। যেমন, শনিবার (১৬ জুলাই) নয়াদিগন্তের স্থানীয় প্রতিনিধি আহাদ আলী নয়ন যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি এএম জুবায়েদ রিপনের বাবার মৃত্যুর খবর পোস্ট করেছেন। সেখানে ৩১ জনকে ট্যাগ করা হলেও সেটা কোনো স্বার্থের জন্য করা হয়নি। আর সাংবাদিক নয়নের ওই পোস্টে যাদের ট্যাগ করা হয়েছে তারা বাইরের কেউ নন, সবাই সাংবাদিকই। কিন্তু নামসর্বস্ব অখ্যাত দৈনিকগুলোয় যেনতেন খবর প্রকাশ হলেই সেগুলো বিশাল ট্যাগবহর দিয়ে পোস্ট করার মাধ্যমে কতিপয় ‘সাংবাদিক’ নিজেদের ‘বড়মাপের সাংবাদিক’ হিসাবে প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে আসছেন। আর তাদের এসব পোস্টে ট্যাগভুক্ত ব্যক্তিদের দুয়েকজন হয়তো খুশি হলেও বাকি সবাই চরম বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যান।

এ অবস্থায় অনাকাঙ্ক্ষিত ট্যাগপোস্ট এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদেরও একটু নজর দেয়া প্রয়োজন। যত্রতত্র ট্যাগপোস্ট সামনে আসাটাই অনেকের কাছে চরম বিরক্তিকর মনে হয়। এক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিরা ট্যাগ অপশন ব্লক করে রাখতে পারেন। ওয়ালে তোলার মতো অথবা দপ্তর সস্পর্কিত কিছু থাকলে তবেই সেটা সামনে আনতে পারেন, নইলে যেখানকার জিনিস সেখানেই ফেলে রাখা উচিত। আমাকেও অনেকে তাদের লম্বা ট্যাগের বহরে যুক্ত করে থাকেন, জরুরি প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া তা নিজের টাইমলাইনে অ্যাড করি না। তাও আবার সেই অ্যাডের সংখ্যাও হাতেগোণা। সর্বশেষ কত বছর আগে কারো ট্যাগপোস্ট টাইমলাইনে অ্যাড করেছি মনে নাই। বিরক্তিকর ট্যাগ প্রসঙ্গে বছরখানিক আগে ফেসবুকে একটি লেখা পোস্ট করেছিলাম। তবু বন্ধ হয়নি ট্যাগবাজদের এই তৎপরতা, বরং আরো বেড়েছে।

❑ লেখক : এস আর সেলিম, সাংবাদিক।

জুলাই ১৭,২০২২ at ২২:৩৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরসে/রারি