পথে পথে ঝুঁকি-দুর্ভোগ মেনেই ঘরে ফিরতে মরিয়া মানুষ

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে দুর্ভোগের বোঝা মাথায় নিয়ে ঢাকা থেকে যেনতেন প্রকারে ঘরে ফিরতে মরিয়া মানুষ। ট্রেনের ছাদে, বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে- যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। নারী-পুরুষ, শিশু, বয়স্ক যাত্রীরা বাসের সিট না পেয়ে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে বাসের ছাদে ও খোলা ট্রাকে চড়ে বাড়ির গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিতে দেখা গেছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন এবং রাজধানীর মহাখালী, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর-গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

এদিকে গত তিন দিনের চেয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। প্রতিটি ট্রেনেরই ভেতরে তিল ধরনের ঠাঁই নেই। ট্রেনের ইঞ্জিনে ও ছাদে শত শত যাত্রীকে ঝুঁকি নিয়ে ঈদযাত্রা করতে দেখা গেছে। বহু নারী-পুরুষকে জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনে ২০ টাকার বিনিময়ে মই লাগিয়ে ছাদে উঠানো হচ্ছে- এমন চিত্র চোখে পড়েছে। গতকালও কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া অধিকাংশ ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। কোনো কোনো ট্রেন ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ছেড়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে ১ লাখেরও অধিক যাত্রী ট্রেনে রওনা করেছেন, অথচ ট্রেনের ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার। গত বৃহস্পতিবার পোশাক কারখানা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছুটি হওয়ায় রেলপথে যাত্রীর চাপ বেড়েছে বলে জানান মাসুদ সারওয়ার। তিনি বলেন, এত বেশি যাত্রীর চাপ এবং মানুষের যে স্রোত, সেটা ঠেকানো যাচ্ছে না। রেলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জিআরপি- সবাই যাত্রী চাপের কাছে ব্যর্থ হয়েছে। বহু যাত্রী ইঞ্জিনে ও ছাদে চড়ে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা করলেও তাদের নামানো যায়নি। ট্রেন দেরিতে ছাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ থাকায় বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রীদের ওঠানামা এবং ছাদে যাত্রী থাকায় ট্রেনগুলো সঠিক গতিতে চলতে পারছে না। যার ফলে শিডিউল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এদিকে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে শত শত মানুষের ঢল। টিকেটের জন্য হন্যে হয়ে কাউন্টারে কাউন্টারে ঘুরছেন তারা। কেউ কেউ অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে পারলেও অধিকাংশ যাত্রী বাস না পেয়ে ট্রাক, পিকআপ, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রী হয়েছেন। অনেকে কয়েক গুণ বাড়তি ভাড়া দিয়ে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যাত্রীরা বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ জানিয়েছেন।

তারা জানান, বাসের সাড়ে ৫-৬শ টাকার ভাড়া হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। আর লোকাল বাসগুলো গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত ছাদে করে যাত্রীপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা এবং পিকআপে করে আরিচা ৫০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। রাজধানীর অনান্য টার্মিনালের মতোই মহাখালীতেও যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। তবে যাত্রীর তুলনায় বাস ছিল না।

এমনকি টিকেট কাটা যাত্রীরাও সময়মতো বাস পাচ্ছেন না। অপেক্ষা করতে করতে সবাই ক্লান্ত, সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে দেখা যায় নারী, শিশু ও বয়স্কদের। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অনেককেই পত্রিকা বা গামছা বিছিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও দেখা যায় এ সময়। টার্মিনাল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে যে বাসগুলো বিভিন্ন গন্তব্য গিয়েছিল, সেগুলো রাস্তায় যানজটের কারণে এখনো ফিরতে পারেনি। সে কারণে বাসের সংকট দেখা দিয়েছে।

মহাখালী বাস টার্মিনালেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন টিকেটপ্রত্যাশীরা। তারা জানান, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী পর্যন্ত যাতায়াতকারী বিনিময় পরিবহন অনান্য সময় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়া নিলেও ঈদের কথা বলে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা ভাড়া নিচ্ছে কাউন্টারে। আবার রাজধানীর সায়েদাবাদেও একই অবস্থা।

সেখানে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অসংখ্য যাত্রী ভিড় করলেও বাসের সংখ্যা কম হওয়ায় অনেকেই বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। আবার অনেকে টিকেট না পেয়ে অন্য উপায়ে ভেঙে ভেঙে যাবার চেষ্টা করছেন। আবার বাসগুলো ছেড়ে গেলেও চিটাগাং রোড পর্যন্ত যেতেই বহু সময় লেগে যাচ্ছে। এদিকে মহাসড়কগুলোর বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে যান জটের সৃষ্টি হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

যাত্রীরা বলছেন, রাত পোহালেই ঈদ, তাই যে করেই হোক পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতেই এত কষ্ট করে বাড়ি ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা। গত কয়েক দিনের তুলনায় গতকাল শুক্রবার রাজধানীর এসব বাস টার্মিনালে ঈদুল আজহা উপলক্ষে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরতে চাওয়া মানুষের অতিরিক্ত চাপ দেখা গেছে। বিভিন্ন বাস টার্মিনালে হাজারো মানুষ টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদিকে বাস কাউন্টারগুলোর টিকেট শেষ। এ অবস্থায় অনেকেই বাসের ছাদে, ট্রাকে বা পিকআপ ভ্যানে চড়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিতে দেখা গেছে। শত শত মানুষ রাস্তায় যান বাহনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।

গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের ২৫-৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর সড়কে দুর্ঘটনা, রাতে টোল আদায় বন্ধ থাকা এবং ঈদকে কেন্দ্র করে মহাসড়কে অতিরিক্ত পরিবহনের চাপের কারণেই এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কের সেতুর গোলচত্বর থেকে হাটিকুমরুল পর্যন্ত ২২-২৫ কিলোমিটার মহাসড়কে থেমে থেমে চলে যানবাহন। যানবাহনের অতিরিক্ত চাপের কারণে কিছু কিছু পয়েন্ট তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে করে ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে যাত্রী ও চালককে। এতে করে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলা ও দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার ঈদে ঘরে ফেরা মানুষকে।

ঈদে যানবাহন ও ঘরমুখী মানুষের চাপে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে গতকাল শুক্রবারও যানজট অব্যাহত ছিল। পরিবহন সংকটের কারণে সাধারণ যাত্রীদের অনেকে ঢাকা থেকে ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছেন। সকাল থেকেই মহানগরীর পাটগুদাম বাসস্ট্যান্ড, শিকারিকান্দা বাইপাস মোড়, ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড, ভালুকা সদর, স্কয়ার মাস্টারবাড়ি, সিডস্টোরসহ বেশ কিছু পয়েন্টে যানবাহনের ব্যাপক চাপের কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়।

যানজটের কারণে ধীরগতিতে চলায় ঘরে পৌঁছাতে যেমন সময় লাগছে তেমনই ঘরমুখী মানুষকে পথে পথে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আবার ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নামে পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। এতে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে প্রায় চার কিলোমিটারজুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, সনাতন পদ্ধতিতে টোল আদায়ের কারণে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ সামাল দিতে একটু সময় লাগছে। এ কারণে সেতুর টোল প্লাজায় যানবাহনের সারি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। তবে অল্প সময়ের মধ্যে টোল দিয়ে যানবাহনগুলো সেতু পার হচ্ছে।

সেতুর মাওয়াপ্রান্তে টোল প্লাজার দায়িত্বে থাকা পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল হোসেন জানিয়েছেন, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ ও সনাতন পদ্ধতিতে টোল আদায়ের কারণে টোল প্লাজায় এসে যানবাহনকে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ কারণে টোল প্লাজা থেকে শ্রীনগরের কেউটচিরায় প্রায় চার কিলোমিটারে যানবাহন ধীরগতিতে টোল প্লাজা অতিক্রম করছে।

এদিকে রাজধানীর অভ্যন্তরে লোকাল বাস প্রায় ছিলই না। যার ফলে যানজট তেমন নেই। তবে কল্যাণপুর বাস টার্মিনাল থেকে গাবতলী হয়ে সাভার পর্যন্ত থেমে থেমে যানজট দেখা গেছে। কল্যাণপুর হানিফ কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা মো. আলম বলছেন, রাস্তার ভয়ঙ্কর অবস্থা। তিনি বলেন, শুক্রবার সকাল ৭টায় যে বাসটি ছেড়ে গেছে দেড় ঘণ্টায়ও সে বাস গাবতলী ব্রিজ পার হতে পারেনি। আর সাভার থেকে ঢাকামুখী বা ঢাকা থেকে সাভার হয়ে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট রয়েছে।

এসআর পরিবহনের কল্যাণপুরের টিকেট বিক্রেতা মো. জিয়া বলেন, চন্দ্রা থেকে ঢাকায় পৌঁছতে সময় লাগছে ১২ ঘণ্টা। তাহলে যথাসময়ে বাস ছাড়ব কী করে। ভোগান্তি যাত্রীদের, ভোগান্তি আমাদেরও। কিন্তু কোনো উপায় নেই। সড়কে গাড়ির চাকা ঘুরছে না।

পরিবহনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, গত রোজার ঈদের তুলনায় এবার যাত্রী সংখ্যা কিছুটা বেশি মনে হচ্ছে। এর একটি কারণ হতে পারে, মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা। গত ঈদে কয়েক লাখ মানুষ বাইকে করে ঢাকা ছেড়েছিলেন। এবার তাদের অনেকে গণপরিবহনে করেই বাড়ি ফিরছেন।

এদিকে যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে বলেও যে অভিযোগ সে বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, অন্যবারের চেয়ে ঈদের যাত্রী চাপ বেড়েছে এটা ঠিক, তবে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি ঠিক নয়।

এদিকে সেই চিরচেনা রূপে ফিরেছে রাজধানীর সদরঘাট। ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো যাত্রীদের লঞ্চঘাটে ছুটে আসা, তাদের তোলার জন্য লঞ্চকর্মীদের হাঁক-ডাক, টিকেট পেতে চলছে যাত্রীদের দৌড়ঝাঁপ-ধাক্কাধাক্কি। অথচ গত ২৬ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বদলে যায় সদরঘাটের স্বাভাবিক চিত্র। যাত্রী খরায় ভুগছিল লঞ্চগুলো। কিন্তু ঈদযাত্রার চতুর্থ দিনে সদরঘাট ফিরে এসেছে তার চিরচেনা ব্যস্ততম চেহারায়। গতকাল সদরঘাট লঞ্চঘাটে সরজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে। এদিকে গত কয়েক দিন ফাঁকা থাকার পর ফের লঞ্চগুলো ভরতে দেখে হাসি ফিরেছে কর্মীদের মুখে। এর আগে যাত্রীদের নানা সুবিধা দিয়েও যাত্রী পাচ্ছিল না লঞ্চগুলো। অবশেষে কেটেছে সেই খরা। গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের চাপ বাড়তে থাকে সদরঘাটে।

জুলাই ০৯,২০২২ at ০৯:২৪:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভোকা/রারি