শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভয়ের আবহ!

নৈতিকতার বিচারে শিক্ষকরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। তারাই মানুষ গড়ার কারিগর। কবি কাজী নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার ভাবার্থ অনুযায়ী দিল্লির বাদশাহ আলমগীর তার পুত্র শিক্ষকের পা ধুয়ে না দিয়ে শুধু পানি ঢেলে যে বেয়াদবি ও শিক্ষককে অবহেলা করেছিলেন- তার জন্য ক্ষমা চেয়ে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন তার সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন, ‘মাননীয় মহাশয়, আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে পাঠালাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন- এটাই আপনার কাছে আমার বিশেষ দাবি। তাকে শেখাবেন পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। এও তাকে শেখাবেন, কীভাবে পরাজয় মেনে নিতে হয় এবং কীভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দেবেন। বইয়ের মাঝে কি রহস্য আছে তাও তাকে বুঝতে শেখাবেন।’

শিক্ষকের মর্যাদার এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে। তবে সেই পরিস্থিতি এখন যে আর নেই। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা সেই বদলে যাওয়ার চিত্রই যেন মনে করিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে নতুন আরেকটি মাত্রা যোগ হয়েছে। সেটি হচ্ছে শিক্ষক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে ‘সাম্প্রদায়িকতা’কে।

১৭ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজে এক ছাত্রের ফেসবুক পেজে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে প্রণাম জানিয়ে ছবিসহ একটি পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে প্রশাসনের উপস্থিতিতে মাইকে ঘোষণা দিয়ে জুতার মালা পরানো হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় কলেজের ৩ হিন্দু শিক্ষকের মোটরসাইকেলএর আগে ২২ মার্চ ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ১০ এপ্রিল হৃদয় মণ্ডল জামিনে মুক্ত হন। এছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় গোপালপুর পঞ্চপল্লি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মিল্টন তালুকদারকে গুরুতর আহত করা হয়। সবশেষ ছাত্রের স্টাম্পের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৭ জুন মারা যান।

দেশের শিক্ষাঙ্গনে বর্তমানে ‘অরাজক’ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত সুশীল সমাজ। শিক্ষকরাও রয়েছেন আতঙ্কে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়; পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ভঙ্গুর চিত্রই যেন এসব ঘটনা সামনে আনছে বলে মনে করেন শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে। যা তারা পাস করার জন্যই পড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ আচার-আচরণ এসবের ক্ষেত্রে মনোযোগ নেই। শিক্ষা প্রশাসনের গাফিলতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষ/প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় এসব ঘটনা ঘটেই চলছে। আর সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলছেন, সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজনীতির সঙ্গে যদি সংস্কৃতির যোগসূত্র ঘটানো না যায়, রাজনীতিকদের যদি সংস্কৃতিমনা করা না যায়। তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

ইতিহাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, পুলিশ শিক্ষক ও ছাত্রের গলায় জুতার মালা পরাবে, এটি কোন বাংলাদেশ? এমন ঘটনা গত ১০০ বছরেও বাংলাদেশে ঘটেনি। বেশ কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য এক শিক্ষককে কানে ধরিয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে মুন্সীগঞ্জে ঘটেছে হৃদয় মণ্ডলের ঘটনা, আমোদিনী পাল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এ তালিকা দীর্ঘ হবে। দেশের আর্থিক উন্নয়নে নজর দেয়া হয়েছে, মানস জগৎ বদলানোর কাজে বিনিয়োগশূন্য।

বিশিষ্ট এই ইতিহাসবিদ মনে করেন, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি ধরন আছে। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন হিন্দুকে অভিযুক্ত করা হয়, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, সারা জীবন তাকে মামলার ঘানি টানতে হয়। যারা ঘটনা ঘটায়, মামলা করে তাদের কিছু হয় না। এসব ঘটনা সাজানো- প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দক্ষিণাংশ জড়িত। ভারতে মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হবে দেখে আমাদের এখানে হিন্দুরা তা হবে কেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা বিশ্বাস করলে প্রশাসনে এতসব উচ্চপদে কোনো হিন্দু থাকতেন না। কিন্তু এমনটা হচ্ছে। কারণ সমাজ আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই।

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির মনে করেন পরিকল্পিতভাবে শিক্ষকদের বিশেষ করে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের টার্গেট করে ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সামনে নির্বাচন, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে থাকা জামায়াতের লোকজন এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। সংখ্যালঘুদেরই কেন নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ধরেই নেয়া হয় যে তারা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। এছাড়া সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তো আছেই। ওয়াজের নামে সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। আর ভারতে যা কিছু হবে এর জন্য বাংলাদেশের হিন্দুরা দায়ী- এমন মানসিকতাও রয়েছে।

৭৫’র পর থেকে বাংলাদেশকে মোল্লা ওমরের আফগানিস্তান বানানোর জন্য সচেতনভাবে এই কাজগুলো করা হচ্ছে। এ দায় সরকারকে নিতে হবে। যে সরকার মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই সরকারের আমলে এমন ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। হেফাজতিদের আস্ফালনের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি? এই বাংলাদেশ দেখার জন্য ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন? আমরা বিশাল বিশাল পদ্মা সেতু বানাচ্ছি, বিশাল মাইলফলকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছি, কিন্তু মানবাধিকার সূচকে এবং মানব উন্নয়নের সূচকে যে বেদনাদায়ক অধোগতি সেটি দেখে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। কোনো সভ্য সমাজে এমনটা হতে পারে না। সরকারের উচিত এর বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া। তা না হলে এর সুদূরপ্রসারি প্রতিক্রিয়া হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ মনে করেন শিক্ষক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বহুদিনের সমন্বয়হীনতা আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষক নির্যাতন আর লাঞ্ছনার এই ঘটনাকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় বেশকিছু ক্ষত আছে, যা দগদগে ঘায়ে পরিণত হয়েছে। সেই ঘায়ের দিকটাই মাঝে মাঝে এসব নেতিবাচক ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। সেগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা করাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ককে বিচার করেছেন ‘পরস্পর নির্ভর, সৌহার্দ্যমূলক হিসেবে।

সে সম্পর্ক শুধু পুঁথিগত বিদ্যা শেখানো ও শেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়।’ কিন্তু শিক্ষার্থীদের আমরা এমন সব শিক্ষা দিচ্ছি, যা কর্মসংস্থান ও জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। শিক্ষার্থীর জ্ঞানের জগৎকে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেই। শিক্ষককেই এই উদ্যোগটি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও দায়িত্ব আছে। কারণ দিনের বেশির ভাগ সময় তারা পরিবারেই থাকছে। এছাড়া একটা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে বোঝানো হতো অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষককে। আর এখন বোঝায় পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে। সমাজ ও বিশ্ব পরিবর্তনের বাস্তবতাকে আমলে নিতে হবে। শিক্ষা, পাঠদান ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নতুনত্ব আনতে হবে।

জুলাই ০৩,২০২২ at ১০:২৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভোকা/রারি