অর্ধশত কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও শুরু হয়নি কাজ

যশোরের দুঃখ খ্যাত ভবদহ নিম্নাঞ্চলের মানুষদের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষার জন্য খননকৃত অভয়নগরের আমডাঙ্গা খালটি চরম অবহেলায় এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। পাউবোর উদাসীনতায় খালটি যথাসময়ে সংস্কার না হওয়ায় খেসারত দিতে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। অর্ধশত কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও খাল সংস্কারের কাজ শুরু না হওয়ায় চলতি বর্ষা মৌসুমে ভবদহ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে ফের ভয়াবহ জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হবে এমনটিই আশংকা ভবদহবাসীর।

সেই সাথে চরম ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে খাল পাড়ের ২৬ টি পরিবারকে। খালের দুই পাড়ে ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় বক গুলো বিলীন হয়ে খাল পাড়ের বাসিন্দাদের ভিটে বাড়িও বিলীন হতে চলেছে। গত বর্ষা মৌসুমে ভাঙ্গনের মুখে পড়ে কেউ কেউ ভিটে-বাড়ি হারিয়ে রাস্তার পাশে অবস্থান নিলেও তা নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা নেই।

গুমরে কাঁদছে আরও ২৬ টি পরিবার। তাদের আশংকা যেকোন সময় খালে গ্রাস করতে পারে তাদের মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু। অনেকের ঘরের দেয়াল পর্যন্ত ছুয়েছে ভাঙ্গন। এদিকে জনবল নিয়োগ থাকায় আমডাঙ্গা ব্রিজের ৬ ভেন্টইস গেট অচল অবস্থায় রয়েছে। দেখভাল করার কেউ নেই। তাছাড়া কপাট ও তালায় মরচে ধরে অকেজো হওয়ার পথে। যা ভবদহ অঞ্চলের মানুষের জন্য অশনি সংকেত।

জানাগেছে, অভয়নগর উপজেলার ঝিকরার বিলের রাজাপুর খাল হতে আমডাঙ্গা খালের উৎপত্তি। সেখান থেকে এঁকে বেঁকে যশোর-খুলনা মহাসড়কের মহাকাল আমডাঙ্গা নামক এলাকার মধ্য দিয়ে ভৈরব নদীতে গিয়ে মিশেছে। সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে ভবদহের নিম্নাঞ্চলে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

সে সময় ২০০৭ সালে মৃত প্রায় খালটিকে স্বেচ্ছায় পুণঃখনন করে জলাবদ্ধ এলাকার হাজার হাজার মানুষ। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর-খুলনা মহাসড়কের উপর খালটিতে ৬ ভেন্টইস গেট নির্মাণ করে। এবং যশোর-খুলনা মহাসড়ক থেকে নদী পর্যন্ত খালের দুইপাড় ব্লক দিয়ে আটকে দেয়। ফলে স্বস্তি ফেরে ভাঙন কবলিত মানুষদের। স্থানীয়রা জানায়, গত বছর জলাবদ্ধ এলাকার মানুষ খালের ভিতর স্কেভেটর দিয়ে পুণরায় খাল খনন করে।

এসময় তারা অপরিকল্পিতভাবে খালের দুই পাড়ের ব্লকগুলো উঠিয়ে ফেলে। তারপর থেকে শুরু হয় ভাঙন। ওই এলাকার অনেকের বসতঘর-গোয়ালঘর, শৌচাগার ভেঙ্গে খালের মধ্যে চলে যায়। এবং খাল পাড়ে থাকা এলাকাবাসীর যাতায়াতের রাস্তাটি সম্পূর্ণ রূপে খালের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। অনেকে ঋণ করে বালির বস্তা এনে খাল পাড়ে দিয়ে নিজেদের শেষ সম্বল ঠেকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। সবকিছুই ভেঙ্গে পড়ছে খালের মধ্যে।

তারা আরও জানায়, গত বর্ষা মৌসুমে আব্দুস সালাম মোড়ল নামের এক ব্যক্তির পাকা ঘর খালে ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমানে সালাম মোড়ল বাড়িঘর ছেড়ে যশোর-খুলনা মহাসড়ের পাশে সওজ এর জায়গায় খুপড়ি ঘর বেঁধে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে সালাম মোড়লের মত অনেককে ভিটে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার উপক্রম হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

সালাম মোড়ল জানান, খাল পাড়ে তার মাত্র চারশতক জমি। তিন শতকের মতো জায়গায় ছিলো তার পাকাঘর। ঘরের দুই তৃৃতীয়াংশ ভেঙ্গে পড়েছে খালে। তার শোয়ার ঘরটিও বিলীন হয়েছে। বর্তমানে উপয়ান্তর না পেয়ে মহাসড়কের পাশে কুঁড়ে ঘর বেঁধে কোনরকম জীবন পার করছেন। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণ বা পুণর্বাসনের জোর দাবি জানিয়েছেন।

ভাঙ্গনের কবলে পড়া মধুসুদন পাল বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে খাল খনন করতে গিয়ে বøকগুলো উটিয়ে ফেলায় তার সর্বস্ব খালে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ইতিমধ্যে তার গোয়াল ঘরটি ভেঙ্গে পড়েছে। তিনি ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খালের পাড়ে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতেও ভাঙ্গনের কবলে

পড়তে হচ্ছে মধুসুদন পালকে। তিনিও পরিবার পরিজন নিয়ে কবে বাড়ি ঘর ছেড়ে গাছতলায় আশ্রয় নিতে হয় সেই আশংকায় দিন পার করছেন। একই আশংকা প্রকাশ করেছেন ষাটোর্ধ বৃদ্ধা সুমিত্রা পাল। তিনি কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। বলেন, মরার খাল আমাদের সবকিছু কেঁড়ে নিচ্ছে। আমাদের রাস্তাও খেয়ে ফেলেছে। আমরা এখন এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যেতে পারিনা। মনে হয় আমরা যেন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করছি।

সরেজমিনে বুধবার আমডাঙ্গা খালের গেটে গিয়ে দেখা যায় ৬ টি গেটই অচল অবস্থায় রয়েছে। গেট অপারেটর রাজু আহমেদ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, গত ৬ মাস পাউবো আমাকে বেতন দেয় না। চাকরি স্থায়ী করণের কথা বলেও পাউবো তা করেনি। তাই আমি আর দেখভাল করছিনা। কয়েকদিন আগে সুন্দলী ইউপি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন এসে খোলার চেষ্টা করেও মরচে ধারার কারনে ব্যার্থ হয়েছেন। অথচ ভাটির সময় গেট খুলে রাখা এবং জোয়ারের সময় বন্ধ রাখার কথা।

এ ব্যাপারে সুন্দলী ইউপি চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, এলাকার বিলগুলোতে এখনো পানিতে ভরে আছে। ঘেরের পাড় না জাগায় মাছ ধরতে পারছেন না মৎস্যচাষিরা। বোরো আবাদ হয়নি প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে। খালের ব্যাপারে পাউবো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। পাউবোর উদাসীনতার কারনে আমরা বছরের পর বছর ভুগছি। একই মন্তব্য করেন প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রভাষক মফিজ উদ্দিন।

এদিকে যশোরের দুঃখ খ্যাত ভবদহ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে স্থায়ী জলাব্ধতার হাত থেকে রক্ষা করতে খননকৃত খালটি সংস্কার না হওয়ায় এবং এখনও বিল-খালে গতবছরের জলাব্ধতা জিইয়ে থাকায় এবার চলতি বর্ষা মৌসুমে স্মরণকালের ভয়াবহ জলাব্ধতায় নিপতিত হওয়ার আশংকা করেছেন ভবদহ জলাবদ্ধ অঞ্চলের বাসিন্দারা। বিশেষ করে অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ, সুন্দলী ও চলিশিয়া ইউনিয়নের মানুষকে যার চরম মূল্য দিতে হবে বলে ভূক্তভোগীদের আশংকা।

পাউবো একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রায় আট মাস আগে আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের জন্য ৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু অদ্যবধি অজ্ঞাত কারনে খাল সংস্কারের কাজ শুরু হয়নি। ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।

এ ব্যাপারে ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরস সংগ্রাম কমিটির সভাপতি, নওয়াপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব এনামুল হক বাবুল বলেন, আমরা বর্ষা মৌসুমের আগে বরাদ্দকৃত টাকায় খাল সংস্কারের জন্য একাধিকবার পাউবো কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দিলেও তারা আমাদের কথার কর্ণপাত করেন নি। বরাদ্দকৃত ৫১ কোটি টাকা কি অবস্থায় আছে, কেন কাজ শুরু হয়নি তারও স্পষ্ট কোন ব্যাখা তারা জানায়নি। পাউবোর উদাসীনতার কারনে আশির্বাদের খালটি অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ ব্যাপারে কথা বলতে পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলামের ব্যবহৃত ০১৩১৮-২৩৫৭১৪ নম্বরে টানা তিনদিন অসংখ্যবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।

জুলাই ০১,২০২২ at ২১:১৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/জাহো/রারি