বানভাসিদের দুর্ভোগ ও পদ্মা সেতুর উৎসব

এস আর সেলিম

৮৮ সালের বন্যা দেখেছিলাম আজাদ প্রোডাক্টসের ভিউকার্ডে, বিটিভিতে। ঢাকার রাজপথ আবার কোথাও কোথাও বাসা-বাড়ি পানিতে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের পানিবন্দি অবস্থার চিত্রই সেসব ভিউকার্ডে বেশি চোখে পড়েছিল। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন- বিটিভিতে তখনকার রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদকে কোথাও হাঁটু পানিতে আবার কোথাও কোমর পানিতে নেমে বন্যাদুর্গতদের খোঁজখবর এবং ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল। সারাদেশে ব্যাপক বন্যা হয়েছিল। আগে বন্যা কিংবা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখনকার মতো ত্রাণের মালামাল নয়ছয় কিংবা আত্মসাতের খবর পাওয়া যেত না। ত্রাণের মালামাল বিতরণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কী পরিমাণ অনিয়ম দুর্নীতির আশ্রয় নেন সেই নজির গেল দুই বছরে করোনার মহামারিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আগেকার ওই সময় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বন্যাকবলিত ফিলিপনগর ইউনিয়নের আবেদের ঘাটে বন্যা দেখতে যেতাম বাইসাইকেলে করে। বয়স ছিল কম, দূরন্তপনা ছিল বেশি। প্রায়ই সাইকেলে করে বন্যা দেখতে যাওয়া হতো। যে কয়দিন গিয়েছি সেই কয়দিনই দেখেছি, তখনকার উপজেলা চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী নৌকায় করে চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে বানভাসিদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন, ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছিলেন। আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমড়া, বাদাম কিনে খাচ্ছিলাম আর বানভাসিদের বন্যা মোকাবিলার লড়াই স্বচোখে দেখছিলাম। যদিও এখানে প্রতি বছর বন্যা হয়। নদী ভাঙে। বন্যা ও নদী ভাঙনের শিকার হতে এখানকার মানুষজন রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এখন আর আগের মতো বন্যা ও নদী ভাঙন দেখতে যাওয়া হয় না।

ঠিক ১০ বছর পরে ৯৮ সালের বন্যার সময়ও ঢাকায় পানি উঠেছিল। সেবারও এই জুন মাসে বন্যা শুরু হয়েছিল। যদিও বর্ষায় ঢাকার পথঘাটে এখনো বন্যার মতো পানি জমে। বর্তমানে প্রকাশনা বন্ধ একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি ছিলাম তখন। কিন্তু আরো বহুল প্রচারিত দৈনিকে প্রতিনিধি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রায়ই ঢাকায় যাওয়া হতো। এ জন্য বিভিন্ন দৈনিকের অফিসে ‘ধর্না’ দেয়াই ছিল মূল কাজ। এমনকি দৈনিক প্রথম আলো বের হওয়ার সময় সেখানেও ঢু মারা হয়েছিল। তাদের মফস্বল সস্পাদক (নাম মনে নাই) জানিয়ে দিয়েছিলেন, নতুন পত্রিকা তাই আপাতত উপজেলা প্রতিনিধি নেয়া হচ্ছে না। তবে তিনি জেলা প্রতিনিধি তারিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে আর তারিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। যাই হোক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সে বছর বন্যা শুরুর দিকে ঢাকায় গিয়েছিলাম। ওই সময় যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হলেও শুরুর দিকে মাঝেমধ্যে ফেরি হয়েও ঢাকা-কুষ্টিয়া বাস চলাচল করতো। বিশেষ করে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুষ্টিয়াগামী অধিকাংশ বাস আরিচা-দৌলতদিয়া রুটের ফেরি হয়ে আসতো।

একদিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে এসবি পরিবহনের কর্তৃপক্ষ জানাল, বন্যার পানিতে ফেরিঘাট ডুবে গেছে। যমুনা (বঙ্গবন্ধু) সেতু হয়ে কুষ্টিয়া ফিরবে তারা। সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া বঙ্গবন্ধু সেতু দিনের আলোয় দেখা হলেও রাতের সেতু দেখা হয়নি। অনেকের কাছে শুনেছিলাম, রাতের আলো ঝলমলে সেতু নাকি অনেক সুন্দর দেখায়। সেই সুযোগে রাতের বঙ্গবন্ধু সেতু দেখা হলো। দূর থেকেই সেতু দেখার অপেক্ষা। কাছাকাছি পৌঁছানোর সময় অনেকে বাসের সিট থেকে উঠে দাঁড়াল। ঘটনা আঁচ করতে পেরে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। আশপাশে চোখ বুলিয়ে কিছুক্ষণ পর বসে পড়লাম। বাস সেতুর ওপর উঠতেই ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো আর যমুনার পানিতে সেই আলোর প্রতিচ্ছবি সত্যিই মনোমুগ্ধকর ছিল। এখন সেই সেতু পুরনো হয়ে গেছে। পুরনো জিনিস কারোরই ভালো লাগে না। বাস কখন সেতুতে ওঠে-নামে তা নিয়ে একটুও ভ্রুক্ষেপ থাকে না। ওইদিন ভোরের দিকে পাকশি-ভেড়ামারা ফেরিঘাটে ফেরি পার হওয়ার জন্য মোটামুটি লম্বা জট লেগেছিল। বন্যায় এই ফেরিঘাটও ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেদিন পদ্মার পানি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টের খুবব কাছাকাছি ছিল, বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছিল। কিছুক্ষণ পরপর বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল। মূলত সেখান থেকে বন্যার বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে এখানকার চরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ার খবর সরবরাহের ব্যস্ততা শুরু হয়। একই সঙ্গে ত্রাণ তৎপরতার খবরও। তখনকার জেলা প্রশাসক আব্দুস সালামের (অত্যন্ত ভদ্র মানুষ) বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন এবং তার চিলমারী ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণের খবর কভার করেছি একাধিকবার। তবে বন্যায় মানুষের মানবেতর জীবন যাপন এবং ক্ষয়ক্ষতির খবরই ছিল মুখ্য। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদের স্থানীয় ফকির বাড়ি কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে চিলমারীতে ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক আব্দুস সালাম। সঙ্গত কারণে সে সময় ফকির বাড়ি কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাথে আমাদের যোগসূত্র থাকায় তারা যতবার ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়েছে ততবারই যাওয়া হয়েছে। যাওয়া হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিতেও। তবে এখন আর আগের মতো দৌড়ঝাঁপ ভালো লাগে না। এখন ডিজিটাল যুগ। এই যুগে খবরের অনেক কিছুই ঘরে বসে পাওয়া যায়। তারপরেও বিশেষ খবরের প্রয়োজনে স্পটেও যেতে হয়।

বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জে হঠাৎ করেই ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়ায় বানভাসিদের সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের মানুষ একেবারেই অপ্রস্তুত থাকায় তাদের দুর্ভোগ-দুর্দশার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। বন্যার পানিতে ভাসছে নেত্রকোণারও বিভিন্ন এলাকাও। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, শুক্রবার (২৪ জুন) পর্যন্ত বন্যায় বিভিন্ন স্থানে ৭৩ জন মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগেই মারা গেছে ৪৮ জন। বন্যার পাশাপাশি অনেক এলাকায় নদী ভাঙনও সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার (২১ জুন) হেলিকপ্টারে বন্যাকবলিত তিন জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পরিদর্শন করে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সংকট মোকাবিলায় বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বন্যায় দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি লাঘবে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙামাটি ও ফেনীসহ আরো কয়েকটি জেলায় বন্যার দেখা মিলেছে। এর মধ্যে পাশের জেলা পাবনা থাকলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পূর্বাভাসে এখনো কুষ্টিয়ার নাম আসেনি। তবে পদ্মায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে কুষ্টিয়ায়ও বন্যা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে পাশের দেশের সঙ্গে পানি বণ্টনের ন্যায্যহিস্যার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় প্রতি বছর আমাদের বন্যার পানিতে ডুবতে হচ্ছে বলে পানি গবেষক ও বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন। যদিও এটা রাজনৈতিক বিষয়। রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলি না। এ নিয়ে কিছু বলাও অতিসাধারণ এই আমার জন্য সমীচীন মনে করি না।

দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার মাঝেই রাত পোহালেই (২৫ জুন) ব্যাপক উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন, বন্যাকবলিতদের সীমাহীন দুর্ভোগে রেখে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে বিলাসী উৎসব করাটা বেমানান। মহাদুর্ভোগ আর মহাউৎসব দুটি পুরোপুরি বিপরীতমুখী বিষয়। যা একসঙ্গে হয় না। তবে অনেকের মতো আমিও ব্যক্তিগতভাবে সমালোচকদের এই সরলিকরণ মানতে নারাজ। একটার জন্য আরেকটা থেমে যাবে, এটা ঠিক না। বলে রাখা দরকার, ৯৮ সালে বন্যা হয়েছিল এই জুন মাসে। আবার ওই বছরের জুন মাসেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করা হয়েছিল। দুই যুগ পরে ২০২২ সালের জুন মাসে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা শুরু হয়েছে। এই জুন মাসেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল, আবার এ সময়েও সরকারে আছে আওয়ামী লীগ। দুদিন আগে (২৩ জুন) ৭৩ বছর পেরোনো, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই হলেন দেশের বৃহত্তম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু দুটির উদ্বোধক। এগুলোকে অনেকটা কাকতালীয় সদৃশ বলা যায়। অনেক আলোচনা-সমালোচনা এবং চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। দেশের এতবড় একটা উদ্যোগ বাস্তবায়নে, কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণে উৎসব করাটাই তো স্বাভাবিক। সুতরাং বন্যার মাঝে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এই উৎসবের সম্পর্কই বা কোথায় তা আমার বোধগম্য নয়। এ নিয়ে চুলকানির দরকার আছে বলেও মনে হয় না।

দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য বিছিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু।

৯৮ সালে বন্যার সুবাদে প্রথমবার রাতে বঙ্গবন্ধু সেতুর সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হলেও ২০২২ সালে এসে পদ্মা সেতুর অপরূপ সৌন্দর্য দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে আরো কিছুদিন। এখনই তড়িঘড়ি করে পদ্মা সেতু দেখতে যেতে হবে এটারও কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দেশের বড় এক বিস্ময় এই সেতু নিশ্চয় উধাও হয়ে যাবে না। আবার সেখানে যেতে পাসপোর্ট-ভিসা দরকার হবে না। সময় সুযোগ মতো অাস্তেধীরে দেখে আসা যাবে। তখনকার সময় এত টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না, অনলাইন সংবাদমাধ্যম ছিল না, ছিল না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপটও। অন্যদিকে আবার সেলফ সেন্সরশিপও ছিল না। দুই যুগের ব্যবধানে পাল্টে গেছে আগের সেই দৃশ্যপট। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। ফলে এসব মাধ্যমে ঘরে-বাইরে যে কোনো জায়গা থেকেই অনায়াসে দেখা যাচ্ছে, পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা স্বপ্নের সেতু। সেতুর ওপর জ্বলে ওঠা রাতের ঝলমলে ল্যাম্পপোস্টের দৃষ্টিনন্দন আলোকচ্ছটা। সেতুর নিচে স্বর্ণালী আলোর বিচ্ছুরণ, যা প্রথম দেখাতেই চোখ জুড়িয়ে গেছে। প্রমত্তা পদ্মার কী শান্ত স্নিগ্ধ রূপ, সত্যিই অসাধারণ। দেখা যাচ্ছে, সেতুটি নির্মাণের অাদ্যপান্তসহ বর্ণাঢ্য উৎসব আয়োজনে সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সব খবরাখবর। অন্যদিকে একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে বানভাসিদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্রও। সবই এখন হাতের মুঠোয়। তবে বানভাসিদের দুর্ভোগ ও পদ্মা সেতু উদ্বোধনের উৎসবকে একাকার করে ফেলার সুযোগ নাই। যার যেভাবে ইচ্ছা গ্রহণ করবেন সেটা নিতান্তই একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। অনবদ্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ দিয়ে উন্নয়নের আরেকটি মাইলফলক উন্মোচন করলেন। সূচনা করলেন এক নতুন দিগন্তের। বিশাল চ্যালেঞ্জিং এতবড় একটি প্রকল্প সম্পন্ন করা চাট্টিখানি কথা না। যেভাবেই হোক এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শতভাগ উত্তীর্ণ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে অনেকেই বলছেন, পদ্মা সেতুতে মানুষের পেট ভরবে না, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের দিশাহারা অবস্থা। এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।

৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু দক্ষিণের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সহজ যোগাযোগের দ্বার উন্মোচিত করবে। বাড়বে সার্বিক উন্নয়নের গতি। সেতু বিভাগের বরাত দিয়ে প্রথম আলোয় আসা খবরে জানা যাচ্ছে, টানা আট বছরের সেতু নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে আছে বিশ্বের ২০টি দেশের মানুষের মেধা। এই লম্বা সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে যুক্ত থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, ডেনমার্ক, ইতালি, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, তাইওয়ান, নেপাল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশ।

সেতু বিভাগ বলছে, পদ্মা সেতুতে বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে চারটি। এগুলো হচ্ছে, ১. প্রকল্পে তিন মিটার ব্যাসের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যের স্টিল পাইলের ব্যবহার করা হয়েছে। এসব পাইল সর্বোচ্চ ১২৫ দশমিক ৫ মিটার গভীরে বসানো হয়েছে, যা আগে কখনো হয়নি। ২. সবচেয়ে লম্বা স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। ৩. সেতুটি ভূমিকম্প সহনীয় করতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার ডাবল কারভেচার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এত শক্তিশালী বিয়ারিং আর কোনো সেতুতে ব্যবহার হয়নি। ৪. চতুর্থ রেকর্ডটি হলো, নদীশাসন কাজের একক সর্ববৃহৎ দরপত্র। সেতুর সুরক্ষায় নদীশাসন করা হয়েছে ১৪ কিলোমিটার। ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এই কাজ করেছে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে শুধু নদীশাসনের জন্য এককভাবে এত টাকার দরপত্র আর আহ্বান করার নজির নেই।

বিগত ৩৪ বছরে দেশে দুইটি (৮৮ ও ৯৮) বন্যা স্মরণীয় হয়ে আছে। এ বছর সিলেট অঞ্চলের আকস্মিক বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় এটাও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রতি বছর বন্যা হলেও এত বছর পর সিলেটের বন্যা পুরো দেশের মানুষকে নতুন করে নাড়িয়ে দিয়েছে। ৩৪ বছরের ব্যবধানে এই তিনটি বন্যা সারাদেশে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে। বন্যা শুরু হলেই তা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের আওয়াজটা বেশ জোরেশোরে শোনা যায়। আবার বানের পানি নেমে যেতে না যেতেই এই আওয়াজ অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসে। তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ খুব জরুরি। যদিও কীভাবে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তার সঠিক ব্যাখ্যা আমার জানা নাই! এ জন্য নদী গবেষক, পানি বিশেষজ্ঞ এবং পরিকল্পনাবিদরা নিশ্চয় ভালো বলতে পারবেন। যাই হোক পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্নের মাঝে আবদ্ধ নাই। এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য বিছিয়ে দিয়ে ৪২টি পিলারের ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পদ্মা সেতু। এর মাধ্যমে পর্যটনসহ নানামুখী সম্ভবনার দুয়ার খুলছে। এখন অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধনকে সামনে রেখে বন্যা প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করা লেখাটি বন্যার প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করছি। আর এ জন্য টেনে এনেছি, দৈনিক দেশবাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাঈদুর রহমান রিমন ভাইয়ের ছোট পরিসরের গুরুত্বপূর্ণ একটা ফেসবুক পোস্ট। ওই পোস্টে রিমন ভাই উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় পানির আগ্রাসী থাবায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সিলেট সুনামগঞ্জ তলিয়ে যায়। বানভাসি মানুষ গত ছয় দিন ধরেই ছিল ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির, পুরোপুরি আশ্রয়হীন। তখন দরকার ছিল জরুরি সরকারি ত্রাণ। এখন সর্বস্তরের মানুষ দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন আর সরকারি জরুরি ত্রাণের দরকার নেই। এ মুহূর্তে ত্রাণের নামে লুটপাটের মচ্ছবই হবে শুধু। বরং সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বেসরকারি ত্রাণের সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থাপনা করা হোক, সরকার নিক দুর্গতদের জন্য পুনর্বাসনের স্থায়ী পদক্ষেপ।

❑ লেখক : এস আর সেলিম, সাংবাদিক।

জুন ২৭,২০২২ at ১৮:৫০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরসে/রারি