পদ্মা সেতু বাঙালির নতুন সূর্যোদয়

স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাঙালির গর্ব, অহঙ্কার, সক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহু-কাঙ্ক্ষিত সেতু দাঁড়িয়ে গেছে। এ যেন সোনার বাংলায় বাঙালির নতুন সূর্যোদয়। এই সূর্যের আলোতে আলোকিত হবে অবহেলিত দক্ষিণ—পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। এ যেন অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। আজ সকাল থেকে এ আলোর মিছিলে শরীক হয়েছেন এপার—ওপারের কোটি কোটি বাসিন্দা।

দুই যুগ আগে যে সেতুর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল, সেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা এবং বাকি অংশের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত হয়ে গেল। তাই পদ্মা সেতু বিভক্ত দুই বাংলার মানুষের কাছে আজ একটি নব দিগন্তের উন্মোচন। আজ নতুন একটি স্বপ্নের যাত্রা শুরু, খুলল পদ্মার দার, উন্মোচিত হল উন্নয়ন অগ্রযাত্রার। এর মাধ্যমে এপার—ওপার হয়েছে এক। আগে যে পথ ফেরির মাধ্যমে পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেতো, এখন সেটি পার হওয়া যাবে মাত্র সাত মিনিটে।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে এ সেতু দ্বারা। এদেশের বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট এটি। যার নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আবার প্রসন্নতার বাণী এই যে, এটা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি। এটা আমাদের মত উন্নতশীল নিম্ন মধ্য দেশের জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। নিজস্ব অর্থায়নে কথাটির দ্বিমত পোষণ করতে পারেন হয়তো।

আচ্ছা ধরুন, আপনি একটি বাড়ি নির্মাণ করবেন যেটা আপনার আয়কে বহুগুনে বাড়িয়ে দিবে সাথে সাথে সোসাইটিতে আপনার আত্মসম্মানও এবং নানা ভাবে আপনি ও আপনার পরিবারের প্রতিটি মানুষ ঐ বাড়ির সুবিধা ভোগ করবে। ঐ বাড়ির নির্মাণ ব্যয় আপনারা কাছে কিন্তু ঐ সময় পরিবারের অন্যান্য ব্যয় বহন করতে আপনার অন্যের কাছ থেকে ধার নিতে হচ্ছে। এখন কথা হলো ধার বাদে বিল্ডিং লোনও নিতে পারছেন কিন্তু শর্ত হলো বাড়ি থেকে যা আয় হবে তার একাংশ তারা নিবে। কিন্তু পরিবারের ব্যয় বহন করতে যে টাকার প্রয়োজন সেটা ধার বা লোন নিলেও সুদ নিতান্তই অনেক কম। প্রশ্ন হলো, এমন অপশন পেলে আপনি কোনটা বেচে নিবেন??

তদ্রুপ দেশের মানুষের জন্য কোনো সরকার যদি রাষ্ট্রীয়ঋণ নেই তাতে দোষের বা খারাপের কিছু নয় কিন্তু। বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ঋণ নেয়ার তালিকায় জাপান উপরে সারিতে। আবার সেই জাপান কিন্তু আমাদের সহ অন্যান্য দেশের ঋণ দেয়। আর কম রাষ্ট্রীয় ঋণ পানামার। ১৯০৪ সালে আমেরিকার পানামায় পানামা খাল খনন করে সেটা ১৯৯৯ সালের ৩১ই ডিসেম্বর পানামার কাছে হস্তান্তর করেন।প্রায় ৯৫ বছর পানামা খাল ও তার পাশের অঞ্চল দখলের বিনিময়ে ১ কোটি ডলার পানামাকে দিয়েছিল আমেরিকা। বর্তমানে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার টোল আদায় হয় এ খাল থেকে। তাহলে হিসাব মিলাই দেখুন,আমেরিকার কাছে খাল ইজারা দিয়ে কি লাভ করেছিলো পানাম? রাষ্ট্রীয় ঋণ থাকা খারাপ কিছু নয় কিন্তু।

পদ্মা সেতুর মতো অতি প্রয়োজনীয় প্রকল্প যে আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি এটা সত্যিই গর্বের বিষয়। পদ্মা সেতু কতোটা প্রয়োজন সেটা ফেরী পারাপারে বিলম্ব জনিত কারণে আপন জন হারানো মানুষ গুলো, খুব সূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করেছে। অর্থনৈতিক সুবিধা দেখলে, বর্তমানে ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, পদ্মানদী পার হয়ে যেখানে ১২ হাজার যান চলাচল করে, সেখানে সেতু খুলে দিলেই যান চলাচল দ্বিগুণ হতে পারে এবং প্রতি বছর যানবাহন ৭-৮ শতাংশ বেড়ে ২০৫০ সালে ৬৭ হাজার যানবাহন চলবে। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ আমরা বিশ্বাসযোগ্য ধরে নিতে পারি। তাছাড়াও পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর উন্নতি হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (এন-৮) ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। যার ফলে ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপিত হবে। সেতুর উভয় পাড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও প্রাইভেট শিল্পনগরী গড়ে উঠবে যেমনটি দেখছি যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ। সেতু নির্মাণ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এটা বলতে পারি, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সপ্নের সেতু নির্মাণ করেছেন চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিঃ। তাই অন্য সেতুর সাথে তুলনা করে এই সেতু নির্মাণ ব্যয় হিসাব করা ঠিক হবে না। নভেম্বর, ২০১৪ থেকে পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৪২টি পিলার ও ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে মূল অবকাঠামো তৈরি সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০। এটি শুধু সেতুই নয় বাঙালির আবেগও!

লেখক: হারুন অর রশিদ জনি
গণিত বিভাগ, সরকারি এম এম কলেজ, যশোর।