বিচ্যুতি এড়িয়ে আদর্শে অবিচল থাকার চ্যালেঞ্জ

‘আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগই। এটা কোনো দল নয়; এটা আমার কাছে একটা অনুভূতির নাম।’ ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই অনুভূতিই কোটি কোটি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর অনুভূতি। যে অনুভূতির সঙ্গে মিশে আছে দেশপ্রেম আর ঐতিহ্যগাথা।

জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা- চার মূলনীতি নিয়ে সাত দশকের অধিক সময়েরও পথচলা। চড়াই-উতরাইয়ের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ‘নৌকা’ প্রতীকে মিশে আছে সংগ্রাম, সংস্কৃতি আর হিমালয়সম গৌরবগাথা ইতিহাস। তবে কখনো কখনো বিচ্যুতি-বিভ্রান্তি যে আসেনি, তা নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই বরাবর সঠিক ধারায় চালিত করেছে দলটিকে। ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে দলটির বর্তমান অবস্থান নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন, অভিযোগ তুলেছেন বিচ্যুতির। সেটা মানছেন আওয়ামী লীগের নেতারাও।

তবে তারা বলেছেন, সময়ের প্রয়োজনে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়ে কারো কারো মনে সংশয় তৈরি হলেও শেষ বিচারে সব বিচ্যুতি-বিভ্রান্তির ফাঁদ এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল থাকবে আওয়ামী
লীগ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলার জনগণের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পাশাপাশি স্বপ্ন গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়া। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্র আর রক্তগঙ্গা সাঁতরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুদৃঢ় প্রত্যয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ, রূপকল্প-২০৪১, ডেল্টাপ্ল্যান আর ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সোনার বাংলার গৌরবে গৌরবান্বিত জাতিতে পরিণত করার আশা জাগানিয়া স্বপ্নের হাতছানি। যদিও জন্মলগ্ন থেকেই আঁধার রাত কিংবা প্রকাশ্য দিবালোকে অদৃশ্য কিংবা দৃশ্যমান শত্রুর ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঝাণ্ডা উড়িয়ে বারবার ধ্বংসস্ত‚পের মধ্যে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে আওয়ামী লীগ। নীলকণ্ঠের মতো সমস্ত বিষকণ্ঠে ধারণ করে মানুষের সেবায় আরো বলীয়ান হয়েছে।

প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছরে এসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা কতটা হচ্ছে আওয়ামী লীগে এমন প্রশ্ন অনেকেরই। এর জবাবে দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, নানা চড়াই-উৎরাইয়ে বিচ্যুতি এলেও আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বাতিঘর মুজিববাদ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করেই তার স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদের রোজ গার্ডেনে আড়াইশ-তিনশ লোকের উপস্থিতিতে মওলানা আবদুল হামিদ খানের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয়েছিল আওয়ামী লীগের। ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী দলের নামকরণ করা হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালি চেতনার ধারক-বাহক হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষানীতি, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছে আওয়ামী লীগ। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রামের পরিণতি পায় মহান একাত্তরে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয় লাল-সবুজের পতাকা ও বাংলাদেশের মানচিত্র। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সব অর্জন ও সমৃদ্ধির ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম, আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কতটুকু : যাত্রার মাত্র ৬ বছর পরই ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে অসা¤প্রদায়িক চেতনায় বাদ দেয়া হয় মুসলিম শব্দটি। স্বাধীনতার পর নতুন নাম হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তরুণ শেখ মুজিব ১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান এবং ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল সভায় পুরোদস্তুর সাধারণ সম্পাদক হন। তখন থেকেই তিনি সার্বক্ষণিকভাবে দলকে তৃণমূলে বিস্তৃত করার কাজে লেগে যান।
বিশ্লেষকদের মতে, আজকের আওয়ামী লীগের ভিত তৈরি হয়েছিল ওই সময়। ইউনিয়ন পর্যায়েও আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ রকম ব্যাপ্তি আর কোনো দলের ছিল না, এখনো নেই।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে একটা বিধান ছিল, সরকারের মন্ত্রী হলে তাকে দলীয় পদ ছেড়ে দিতে হবে। এই বিধান মেনে নিয়ে ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিব প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিপদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সরকারে হারিয়ে গেছে দল।

অন্যদিকে দলের মধ্যে সংহতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভাব দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, স্বাধীনতা এসেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এটি অনেক বড় অর্জন। সামরিকবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত ১২ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক বড় ভূমিকা আওয়ামী লীগের। যদিও অসমতার ব্যাপারে কিছুটা প্রশ্ন রয়েছে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের মানুষের স্বপ্নের সীমা বৈশি^ক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। তবে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অবশ্য চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের একক বিষয় নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার কমন রাজনৈতিক চিত্র। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একযুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা দলের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্বের খবর প্রায়ই পত্রিকার শিরোনাম হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এই বৃহৎ দলটিকে এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে দলের ভেতর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।

এদিকে দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, পুরান ঢাকার রোজগার্ডেন থেকে আজ গণভবন থেকে দেশের সেবা করছে আওয়ামী লীগ। পরপর তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগই ভাষার অধিকার আদায় থেকে ভাতের অধিকার নিশ্চিত করেছে। স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব, সংবিধান প্রণয়ন, জাতিসংঘ সদস্য লাভসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব, কোভিড বিশে^ও উন্নয়নের রোলমডেল, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেলÑ উন্নয়নের মহাযজ্ঞের নেতৃত্বের নাম আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উন্নয়নের মহাসড়কে বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলার বিনির্মাণের।

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে দলীয়প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ হচ্ছে এই উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন একটা দল। একেবারে গণমানুষের মাধ্যমে। সেই সময়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে, তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ করতে গিয়েই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগ আজ যখন ৭৩ বছর পালন করছে, তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের এবং দেশেরও। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ’৭৫ এর পর থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল, সেখান থেকে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। দেশের সেবা করছেন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে দলকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও এই আদর্শকে দীর্ঘ চলার পথে বাঁকে বাঁকে বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে, বহু ঝড়-ঝঞ্চা পেরিয়েছে, এরপরও শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ টিকে রয়েছে। আদর্শ থেকে কখনোই বিচ্যুতি হয়নি, বরং প্রতি মুহূর্তেই আদর্শকে লালনপালন করে। আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যই নিরবচ্ছিন্নভাবেই লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আদর্শের জন্যই আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনে পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ একটি বিশাল ক্যানভাস। এটি ধরে রাখাও বেশ দুরুহ। পরিপূর্ণ একটি পরমতসহিষ্ণু, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ও উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা এক বিশাল অভিযাত্রার বিষয়। এই অবিনাশী স্বপ্ন, আদর্শ ও চেতনা পূরণ করা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। ৭৩ বছর বয়সি চির তরুণ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে তার স্বপ্ন ও চেতনা বাস্তবায়নের পথে অবিচল ও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলছে। এই প্রশ্নে জাতির পিতার বিদূষী কন্যা, বাঙালির আপন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তা এবং সময় ও বাস্তবতাকে ধারণ করে বিজ্ঞ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে দেশপ্রেমিক নাগরিকগণের অধিকতর অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সবাইকে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে খোলামনে শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আস্থাশীল হয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাই।

ref: bhorerkagoj