নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিস্তা ব্যারেজের ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল যেন কোন ভাবেই থামছেনা। নিয়ন্ত্রণ আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা আদায় করলেও আসছেনা কোন কাজে। এসব ঠেকাতে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা দায়িত্বে থাকলেও তারা যেন নীরব দর্শক। কারো মাঝে নেই কোন ভয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুমিকা ও ব্যারেজের স্থায়িত্ব নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানান প্রশ্ন। দ্রুত ভারি যানবাহন চলাচল বন্ধ করা না হলে ব্যারেজটির মারাত্মক ধরনের ক্ষতি হতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা।

ট্রাক প্রতি মাসিক ২ হাজার টাকা নিয়ে প্রায় ৩শত ট্রাক তিস্তা ব্যারেজের ওপর দিয়ে চলাচল করে বলে জানা গেছে। এ টাকা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা ও কিছু মিডিয়া কর্মীদের মাঝে ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে। বিষয়টি নজরে আসলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে পাথর বোঝাই ট্রাক আটক করে জরিমানা আদায় ও বিকল্প রাস্তা দিয়ে ট্রাক ফিরিয়ে দেয় জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রশাসনের মাঝে সমন্বয়হীনতার কারণে অভিযান শেষ হবার পর থেকেই আবারও শুরু হয় পাথর বোঝাই ট্রাক চলাচল। পুলিশ ও আনসার সদস্যদের এসব বন্ধে কোন মাথা ব্যথা নেই। ফলে এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানী এলাকায় তিস্তা নদীর উপর তিস্তা সেচ প্রকল্প হিসেবে ‘তিস্তা ব্যারেজ’ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ সালে তিস্তা ব্যারেজের মুল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও ক্যানেলসহ অন্যান্য কাজ শেষ হয় ১৯৯৮ সালের জুন মাসে। এ অবস্থায় ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ব্যারেজের উপর দিয়ে ২০ টনের নিচে সব যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করে। সেই থেকে প্রতিবছর সরকার কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব আয় করতো।

এ সুযোগে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে ২০ টনের অধিক ৪০-৫০ টনের বেশি ওজনের ভারী যানবাহন চলাচলের সুবিধা দেয়। ফলে দিনদিন ব্যারেজের আয়ুষ্কাল কমতে থাকে। দেখা দেয় চিরচির ফাটল। বিষয়টি নজরে আসলে সরকার ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর ব্যারেজের উপর দিয়ে সকল প্রকার ভারী যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে টোল আদায় বন্ধ করে ব্যারেজের উভয় গেটে মূল রাস্তার ৭ ফিট ৮ ইঞ্চি ফাঁকা রেখে লোহার পাইপ বসিয়ে রাস্তা সংকীর্ণ করে দেয়।

এর কিছুদিন পর কিছু ট্রাক মালিক ব্যারেজের অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে তাদের ট্রাকের বোডি কেটে চিকোন ও লম্বা করে। রাস্তা সংকীর্ণ করা লোহার পাইপ ভেঙে পুনরায় চলাচল সচল হয় ভারী যানবাহন। সরকারি এ নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে লক্ষ লক্ষ টাকা মাসোহারার বিনিময়ে পুনরায় ভারী যানবাহন চলাচল শুরু করার ফলে পুনরায় ব্যারেজের আয়ুষ্কাল নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

হালকা যানবাহনের স্থানে চলাচল করছে পাথর বোঝাই ছোট থেকে মাঝারি ট্রাক। এ সুযোগে লালমনিরহাট হয়ে না গিয়ে তিস্তা ব্যারেজ অতিক্রম করে নীলফামারী হয়ে সারা দেশে যাচ্ছে বুড়িমারী স্থলবন্দরের পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য বোঝাই ট্রাক। ফলে কমে আসছে লালমনিরহাট রংপুর মহাসড়কের তিস্তা সড়ক সেতুর টোল আদায়। একই কারণে কমে আসছে তিস্তা ব্যারেজের আয়ুষ্কালও। তিস্তা সড়ক সেতু হয়ে ঢাকা যেতে টোলসহ অনেক দূরের পথ অতিক্রম করতে হয়। তাই টোল ও জ্বালানি বাঁচাতে তিস্তা ব্যারেজের সামান্য কিছু উৎকোচ দিয়ে পার হচ্ছে এসব পাথর বোঝাই ট্রাক।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক একজন ট্রাক চালক বলেন, ‘টাকা ছাড়া ব্যারেজে পাথর বোঝাই গাড়ি তোলা সম্ভব নয়। মাসিক দুই হাজার টাকার বিনিময়ে তিস্তা ব্যারেজের ওপর দিয়ে পাথর বোঝাই ট্রাক চলাচল করি। ব্যারেজ হয়ে চলাচল করলে তিস্তা সড়ক সেতুর টোল ও অতিরিক্ত জ্বালানি দু’টোয় বেঁচে যায়।

তিস্তা ব্যারেজে ইউএনওর অভিযান প্রসংঙ্গে সাদ্দাম হোসেন বলেন, এসব ঘটনা দেখলে সাধারণ জনগণ হাসিপায়। আমার মনে হয় এতে সরকারের ও ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। কারণ তিস্তা ব‍্যারেজে এত গুলো আনসার, পুলিশ দায়িত্ব রয়েছে। এরপরও কি জন‍্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়কে ভ্রাম‍্যমান আদালত চালাতে হবে। সরকার কি জন‍্য আনসার এবং পুলিশকে বেতন দিয়ে রাখছে।

আরো পড়ুন :
সিলেটে বন্যার পানি কমতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে
বন্যার্তদের মাঝে মানবিক সাহিয্যে এগিয়ে এসেছে সিলেট জেলা পুলিশ

গড্ডিমারী ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক শ্যামল বলেন, তিস্তা ব্যারেজের দায়িত্বে থাকা অসাধু কর্মকর্তাদেরকে উৎকোচ দিয়ে পাথর বোঝাই ট্রাকসহ ভারি যানবাহন চলাচল করে। বিষয়টি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে তুলে ধরে এসব বন্ধ করার জন্য দায়িত্ব চেয়েছিলাম।

তিস্তা ব্যারেজের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সিদ্দিক বলেন, আমরা চলি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিনে। তাদের অনুমতি ছাড়া কোন কিছুই করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে ইউএনও আসলে আবারও আমরা সহযোগিতা করব। এর বাহিরে আমাদের করার কিছুই নাই।

হাতীবান্ধা থানার অফিসার্স ইনচার্জ ওসি এরশাদুল আলমকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, পাথর বোঝাই ট্রাক কিভাবে চলাচল করে। এর কোন সুযোগ নেই। বিষয়টি দেখতেছি।

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন বলেন, বিষয়টি নজরে আসার পর শনিবার বিকালে তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় কয়েকটি পাথর বোঝাই ট্রাক আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা আদায় করে বিকল্প রাস্তা দিয়ে ট্রাক গুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়। এরপরও ব্যারেজ রক্ষায় দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে তাহলে আমার একার পক্ষে কি করার আছে। তবে সামনে জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে বিষয়টি তুলে ধরাসহ তার অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান।

তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া পয়েন্টের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা উদ দৌলা প্রিন্স বলেন, বিষয়টি নজরে এসেছে। এ নিয়ে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলাসহ চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাদের নির্দেশ পেলে ব্যারেজের স্থায়িত্ব রক্ষায় খুব দ্রুত এসব যানবাহন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ মাঝখানে আরও খুটি বসানো হবে।

জুন ২০,২০২২ at ১৬:১২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/কাআজা/রারি