মহানবি’র মর্যাদা

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাজারও পংক্তিমালা মধ্যে ভেসে আসে শ্রবণে। ইচ্ছে করে বার বার উচ্চ কন্ঠে গাই ‘যেই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবি হযরত’।

প্রিয়ারা নবি রাসুল (সা:)-এর পবিত্র জীবন হচ্ছে সৃষ্টিকুলের জন্য অনুপম আদর্শের দর্পণ। যাঁর আদর্শ অতুলনীয়, অদ্বিতীয়, চিরস্মরণীয়, চিরঅনুকরণীয় ও প্রশংসিত। দুনিয়া জীবনে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভের ক্ষেত্রে রাসুল (সা:)-এর আদর্শ ছাড়া মুক্তির বিকল্প পথ নেই। ইরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্টিত’ (সুরা:কলম-৪)। অন্যত্রে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুল (সা:)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (সুরা:আহযাব-২১)। মানুষের ইহকাল ও পরকালীন মুক্তির জন্য রাসুল (সা:)-এর মহান আদর্শকে মানুষের জীবনে অবশ্যই পালন করতে হবে। রাসুল (সা:)-এর মহান আদর্শকে পালনাত্রে ইরশাদ হচ্ছে- ‘রাসুল (সা:) তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক’ (সুরা: হাশর-৭)। পৃথিবী যখন নিকষ আঁধারে ডাকা চারিদিক।

কোথাও নেই সামান্যতম আলো। সত্য ও সভ্যতার জীবন্ত কবর রচনা করেছিলো অসত্য ও অশ্লীলতা। জীবন্ত পুঁতে ফেলা থেকে শুরু করে হেন কোনো অপরাধ নেই, যা তখন করা হতো না। যেনো মানুষ নয়, জন্ম নেয় একেকটা পশু। পাশবিক-পৈশাচিক সকল মন্দ আচরণ ছিলো মানুষের নিত্য কাজ। খুন, লুণ্ঠন, ছিনতাই, ধর্ষণ হয়ে উঠেছিলো তাদের নিত্যদিনের কাজ। পৃথিবীর এ দুর্দশাগ্রস্ত চরম নাজুক পরিস্থিতিতে ‘কুল মাখলুকে’র জন্যে রহমত হিসেবে ৫৭০ খৃস্টাব্দে ১২ ই রবিউল আউয়াল পৃথিবীর বুকে প্রেরিত হন অনুপম আদর্শের মহামানব রাসুল (সা:)।

রাসুল (সা:)-এর আবির্ভাবে সমগ্র দুনিয়ার অন্ধকার বিদূরিত হয়ে সত্যের আলোয় পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়েছিল। তাঁর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ও সুকোমল পরশে পাল্টে যেতে থাকে পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র। সজীব, সতেজ, নির্মল হয়ে ওঠে মানবাত্মা। আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় পৃথিবীর পূর্বে-পশ্চিমে সমানভাবে। পৃথিবী দেখতে পায় আলোর মশাল, আলোকিত ফোয়ারা। বয়ে চলে শান্তির ফল্গুধারা। অপার্থিব প্রশান্তি ছুঁয়ে যায় তার অনুসারীদের। পৃথিবীর যে প্রান্তের যে মানুষই তাকে অনুসরণ করেছে, সেই শান্তির নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। যুগ-যুগান্তরে, একালে-সেকালে সবখানে। রাসুল (সা:) বলেছেন- ‘উৎকৃষ্ট চারিত্রিক গুণাবলীকে পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যেই আমি প্রেরিত হয়েছি।’

অন্যত্রে রাসুল (সা:) বলেছেন- ‘আমি মহত্তম কার‌্যাবলীকে পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছি।’ রাসুল (সা:)-এমন এক আদর্শের মহামানব, যার জীবনে ভূল নামক শব্দটির সংযোজন হয়নি। পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ মনীষী মাইকেল এইচ, হার্ট তার ‘দি হানড্রেড’ গন্থে পৃথিবীর বিখ্যাত একশত ব্যক্তিত্বের তালিকায় রাসুল (সা:)-কে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেন। লেখক এব্যাপারে বলেন, রাসুল (সা:)-কে বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীদের তালিকায় শীর্ষে আমি স্থান দিয়েছি। এতে কেউ কেউ আশ্চর্য হতে পারেন। আবার কেউ এ নিয়ে প্রশ্নও করতে পারেন।

কিন্তু মানব জাতির ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় ক্ষেত্রে একযোগে বিপুলভাবে সফল হয়েছেন। বিশিষ্ট লেখক টলষ্টয় বলেন, আমি রাসুল (সা:)-থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবী ভ্রান্তির আঁধারে নিমজ্জিত ছিল। তিনি সে আঁধারে আলো হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন। আমার বিশ্বাস করতেই হবে যে রাসুল (সা:)-এর প্রচার ও পথ নিদের্শন যথার্থ। জোসেফ হেল বলেছেন, রাসুল (সা:)-এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন, যার আবির্ভাব না হলে, অসম্পূর্ণ থেকে যেত।

তিনি নিজেই নিজের তুলনা; তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ কার‌্যাবলী নি:সন্দেহে মানব ইতিহাসের এক সমুজ্জল অধ্যায়। জর্জ বাণার্ড শ’ বলেছেন, যদি গোটা বিশ্বের যাবতীয় ধর্ম সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে কোন এক নায়কের শাসনাধীনে আনা হত তবে একমাত্র রাসুল (সা:)-ই সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।

রাসুল (সা:)-এর মহৎ চরিত্রে ছিল সকল মহৎ গুণের সমাহার। মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা ও আচার ব্যবহারে তিনি ছিলেন খুব অমায়িক ও উদার। কেউ মনে আঘাত পেতে পারে এরূপ কোনো কথা কখনও তিনি বলতেন না। মুমিনের সুখ-শান্তি, সম্পদ-সমৃদ্ধি, সম্মান-মর্যাদা সবকিছুই নির্ভর করে তার অনুসরণ-অনুকরণের ওপর। যে ব্যক্তি রাসুল (সা:)-এর জীবনকে যতটুকু অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তি নিজ জীবনে ততটা সফল ও স্বার্থক হবে। মানব জীবনের প্রার্থিত আরাধ্য ধ্যান-জ্ঞান হলো আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি।

পরকালের নাজাত মুক্তি। এবং এরই মাধ্যমে অনন্ত সুখের জান্নাত নিশ্চিত করা। রাসুল (সা:)-বলেছেন, ‘যে আমার সুন্নতকে (পালন ও প্রচারের মাধ্যমে) জীবিত করবে, সে আমাকেই ভালোবাসবে। আর যে আমাকে ভালোবাসবে, সে আমার সাথেই জান্নাতে থাকবে (তিরমিজি)। যখন আমরা জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে রাসুল (সা:)-এর অনুসরণ-অনুকরণ করবো তখন আল্লাহ আমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আমাদেরকে ঢেকে নেবেন তাঁর দয়া, রহমত ও করুণার চাদরে।

তখন পৃথিবীর সব শান্তি-সমৃদ্ধি ধরা দেবে আমাদের। ইসলাম আমাদের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আর রাসুল (সা:)-এর জীবন্ত নমুনা। আয়শা (রা:) তাঁর অনুপম ভাষায় রাসুল (সা:)-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘কুরআনই তাঁর চরিত্র’ (আদাবুল মুফরাদ )। তাঁর জীবন-ই কোরআন, কোরআন-ই তাঁর জীবন। অনত্রে ইরশাদ হচ্ছে, রাসুল (সা:)-এর মাঝেই তোমাদের জন্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’ (সুরা: আহজাব-২১)।

মানুষ যদি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে স্থিতি, শান্তি, সমৃদ্ধি পেতে চায় তাহলে রাসুল (সা:)-এর জীবনাদর্শ ব্যতীত অন্য কোথাও তা পাবে না।

এটাই একান্ত এবং একমাত্র পথ যা মানব জীবনের প্রতিটি অনুসঙ্গের বিশ্বস্ত সমর্পিত পথ। এর বাইরে যা আছে সবই চাকচিক্য, মরিচিকা ও অন্তসারশূন্য। রাসুল (সা:)- দুনিয়ায় এসেছিলেন আমাদেরকে সৎপথ দেখাবার জন্য। আল্লাহ মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও সঠিক পথের নির্ণায়ক মাপকাঠি হিসেবে রাসুল (সা:)-কে মানবীয় সকল গুণের অধিকারী করে প্রেরণ করেছেন। তাঁর মাঝে প্রশংসিত সকল গুণের সমাবেশ ঘটেছিলো।

আর সেই অনুপম আদর্শের উজ্জ্বল বিভায় পতঙ্গের মতো আছড়ে পড়েছিলো পুরো পৃথিবী। সত্য ও সুন্দরের বিজয় হয়েছিলো তাঁরই হাতের স্পর্শে। সভ্যতার চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ পাঠ অধ্যয়নে তো পৃথিবী তার কাছেই ঋণী। পৃথিবী পেয়েছিলো ইতিহাসের সবচেয়ে আলোকিত ও মহিমান্বিত হাতে গড়া সমাজব্যবস্থা। যা এর আগে ও পরে কেউ পারেনি, আর কখনও পারবে না। মুসলিম-অমুসলিম সকলেই তাঁর আদর্শকে মেনে নিয়েছিলো নির্বিবাদে। তিনি ছিলেন পৃথিবীর জন্য শ্রেষ্ঠতম উপহার ও রহমত স্বরূপ।

তাঁর চেয়ে সুন্দর, তাঁর চেয়ে মহৎ, তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাঁর চেয়ে পূর্ণ, তাঁর শ্রেষ্ঠ আদর্শবান আল্লাহর সৃষ্টিতে আর কেহ নেই, আর হবে না। আমাদের শান্তি ও মুক্তির জন্য রাসুল (সা:)-এর আদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতেই হবে। এ আদর্শই সার্বজনীন ও চিরন্তন। হে আমাদের রব! রাসুল (সা:)-এর আদর্শ সঠিকভাবে পালন করার দাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক

জুন ১১,২০২২ at ১৩:৩৪:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মুশাইসা/রারি