সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি : নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা!

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি মালিকানাধীন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা শুধুই কি দুর্ঘটনা; নাকি এর পেছনে অন্য কোনো বিষয় রয়েছে- বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে অনেককেই। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও এ ব্যাপারে নিবিড় তদন্ত শুরু করেছে। একাধিক মন্ত্রীও এরই মধ্যে সীতাকুণ্ডের ঘটনা নিয়ে তাদের সন্দেহের কথা বলেছেন। কন্টেইনার ডিপোটি যে স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালকও এটিকে নাশকতা হিসেবে অভিযোগ তুলেছেন। সুতরাং এটিকে শুধু দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে সচেতন মহল মনে করছেন।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেলে মোহাম্মদ কায়েস নামে এক রোহিঙ্গা যুবক তার নিখোঁজ ভাই মোহাম্মদ ফারুকের খোঁজ করতে এসেছিলেন। তার দাবি, তার ভাই ফারুক ৫ মাস ধরে এই কন্টেইনার ডিপোতে কাজ করছে। শুধু তার ভাইই নয় এখানে আরো ২০ রোহিঙ্গা যুবক (মিয়ানমারের নাগরিক) কাজ করছে বলে তার দাবি। এই যে রোহিঙ্গা যুবকরা এই কন্টেইনার ডিপোতে কাজ করত বলে তথ্য পাওয়া গেছে, সেটিও এক ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।

যে স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিএম কন্টেইনার ডিপো, সেই স্মার্ট গ্রুপের জিএম মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকি গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, যদি কোনো না কোনোভাবে রোহিঙ্গারা এখানে কাজ করে থাকে বা কাজ করার সুযোগ পায়, সেটিও আমাদের চিন্তার বিষয়। বিষয়টিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।

তবে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল বলছে, এই যে রোহিঙ্গা যুবকরা দেশের আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত একটি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোতে কাজ করছে, সেটিও কিন্তু এর নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ এসব রোহিঙ্গা যুবকদেরকে আমাদের দেশের বিভিন্ন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নানা সময়ে নানা নাশকতার কাজে ব্যবহার করেছে। এই রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও নাশকতা কাজে যে লিপ্ত, সে ব্যাপারে আমাদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য রয়েছে। এসব রোহিঙ্গার কাউকে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল ব্যবহার করে আগুন লাগিয়ে দিয়ে নাশকতা করায়নি তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে গত শনিবারের অগ্নিকাণ্ড ও বিধ্বংসী বিস্ফোরণের পেছনে কোনো নাশকতা ছিল বা ষড়যন্ত্র ছিল- এমন সন্দেহ একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

গত শনিবার রাতের ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও প্রলয়ঙ্করী শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনাটিকে ‘নাশকতা’ সন্দেহ করে কোনো পক্ষ ফায়দা লুটতে চাইছে কিনা, সে বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যেই সরকারের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রশ্ন তুলেছেন।

সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনাটি পদ্মা সেতু উদ্বোধন আনন্দকে অবদমনে নাশকতা কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে, এমন মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গত সোমবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণে দগ্ধদের দেখতে গিয়ে মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি দেশের ভাবমূর্তি এবং রপ্তানি বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করাই উদ্দেশ্য, তা তদন্তের বিষয়।

তিনি বলেছেন, আপনারা জানেন পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার পর এবং পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করার পর দেশে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটির ধারাবাহিকতায় দেশবাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনায় কোনো নাশকতা আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।

সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ফায়ার ফাইটার মো. শাকিল তরফদারের জানাজায় অংশগ্রহণ শেষে গতকাল মঙ্গলবার উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও তার সন্দেহের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গাফিলতি পেলে বা যদি কেউ জড়িত থাকে, সে যে দলেরই হোক না কেন তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘটনার সঙ্গে যদি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকে, তাহলে আপনারা নমনীয় হবেন কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা কি কখনো দেখেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী কাউকে ছাড় দিয়েছেন। সংসদ সদস্যকেও ছাড় দেননি। আমাদের মেসেজ স্পষ্ট, যদি কারো সম্পৃক্ততা এবং কারো গাফিলতি পাওয়া যায়, অবশ্যই তাদের শাস্তি পেতে হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামে আমাদের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম কাজ করছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কার গাফিলতি, কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, কেউ পুড়িয়েছে কিনা কিছুই বলা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে, না হলে এতগুলো প্রাণ যায় না। সেটা আমি বিশ্বাস করি।

যে স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিএম কন্টেইনার ডিপো, সেই স্মার্ট গ্রুপের পরিচালক মো. আজিজুর রহমানও দাবি করেছেন যে ঘটনাটি নাশকতা। গত রবিবার তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেলে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিকদের কাছে বলেন, আমি নিশ্চিত কেউ না কেউ সেখানে নাশকতা ঘটিয়েছে। তবে কে ঘটিয়েছে তা জানি না, এটি তদন্তসাপেক্ষ। তা নাহলে শুধু একটি কন্টেইনারে কেন বিস্ফোরণ হবে?

এরই মধ্যেই ঘটনা তদন্তে কমপক্ষে ছয়টি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা তাদের মতো করে তদন্তের কাজ করছেন। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও নিবিড়ভাবে ঘটনার চুলচেরা তদন্ত করছেন। সঠিক তদন্ত হলে বের হয়ে আসবে কারো গাফিলতিতে এত বড় মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয় ঘটল নাকি এর পেছনে কোনো নাশকতা কাজ করেছে।

জুন ০৮,২০২২ at ১০:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভোকা/রারি