শাওয়াল মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইসলাম এমন এক শান্তিপ্রিয় ধর্ম, যার মাঝে কোনো ধরনের কঠোরতার শিক্ষা পাওয়া যায় না। মুসলমান হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমরা সেই মহান রসুলের উম্মত যিনি রহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে আল্লাহপাক বিশ্ববাসীর জন্য প্রেরণ করেছেন। তিনি (সা.) সেই সম্পূর্ণ এবং পরিপূর্ণ শরীয়ত নিয়ে এসেছেন এবং সেই শিক্ষা নিয়ে এসেছেন যা বান্দাকে খোদার সাথে মিলিত করে।

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে হজরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা রাখল, এরপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় গোনাহমুক্ত হয়ে গেল’ (আল মুজামুল আওসাত)।

তিনি তার অনুসারীদের সুমহান আধ্যাত্মিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছেন। মানুষের কীভাবে পাপমুক্ত থাকতে পারবে এবং কীভাবে খোদার নৈকট্য অর্জন করতে পারবে এ সব বিষয়ের প্রতি তিনি (সা.) বিভিন্নভাবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।

আল্লাহতায়ালার রহমতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ পবিত্র মাহে রমজানের দিনগুলো বিশেষ ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছে, আলহামদুলিল্লাহ। রমজান শুরুর পূর্বে ভেবেছিলাম এতো বড় দিন আর এই গরমে কিভাবে রোজাগুলো রাখবো? হয়তো বেশ কষ্ট হবে অথচ যে দিন থেকে রোজা শুরু হলো আল্লাহপাক প্রকৃতির মাঝে যেন জান্নাতি বাতাস বইয়ে দিলেন আর প্রতিটি মুসলমান অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে রোজার দিনগুলো ইবাদতের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন।

আমরা যারা রমজানের সবগুলো রোজা কেবল আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির খাতিরে রেখেছি তারা অবশ্যই বড় সৌভাগ্যবান। এখন রমজানের বিভিন্ন সৎকর্মগুলো বছর ব্যাপী জীবিত রাখতে। আমরা যদি বছরের প্রতিটি দিন আল্লাহপাকের আদেশ নিশেধ মেনে চলে জীবন অতিবাহিত করি তাহলে অবশ্যই আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন।

আমরা কেউ জানি না, আগামী রমজান লাভ করার সৌভাগ্য আমাদের হবে কি না। রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা তাকওয়া, অন্তরের পরহেজগারী, হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা এবং খোদাতায়ালার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি যাবতীয় গুণাহসমূহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে আর আল্লাহ ও রসুলের শিক্ষা মতাবেক জীবন পরিচালিত করতে।

কিন্তু রমজানের রোজার দিনগুলো শেষ হতে না হতেই আমরা দেখতে পাই আমাদের স্বভাব-চরিত্র পূর্বের ন্যায় হয়ে যায়। রোজার দিনগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বা জামাত আদায় করার প্রতি যেমন আকর্ষণ ছিল রমজান শেষ হতে না হতেই নামাজের প্রতি কেমন যেন উদাসীন হয়ে যাচ্ছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকভাবে আদায় করার প্রতি দেখা দিচ্ছে আলস্য, কথা বলার ক্ষেত্রেও আবার মিথ্যা বলা শুরু করে দিয়েছি, নানান খারাপ কাজে আবার যোগ দিয়েছি।

এক কথায় বলা যায় যেই নাকি রমজান শেষ হলো সব ধরনের অপকর্ম আবার শুরু হয়ে যায়। আমরা যদি মনে করি রমজানের রোজাতো রাখলামই এখন আর ধর্ম-কর্ম ঠিকভাবে পালন করে কি করবো আবার আগামী বছর রোজা রেখে খোদার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব।

এমন চিন্তা-ভাবনা যদি কারো মনে জাগ্রত হয় তাহলে সে মারাত্মক ভুল করবে। রোজার দিনগুলো হচ্ছে প্রশিক্ষণের দিন, এই প্রশিক্ষণ মতাবেক বছরের এগারো মাস অতিবাহিত করলেই না আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভ সম্ভব হবে। আর না হয় এক মাস রোজা রাখার পর আবার যদি খারাপ কাজে জড়িয়ে যাই তাহলে এই রোজা আমাদের জীবনের কোন পরিবর্তন বয়ে আনবে না।

আমাদের রোজা তখনই আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে যখন আমরা রমজানের পর বাকি এগারো মাস রমজান মাসের দিনগুলোর মতই নিজের জীবন অতিবাহিত করব। রমজানে যে বিষয়গুলো প্রশিক্ষণ নিয়েছি তা বাকি দিনগুলোতে কাজে লাগাতে হবে তাহলেই আমাদের রোজা খোদার দরবারে গ্রহণীয়তার মর্যাদা পাবে।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচ বেলার নামাজ, এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা এবং এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজান পর্যন্ত মধ্যবর্তী পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়। শর্ত হলো, মানুষ যদি বড় বড় গুনাহ এড়িয়ে চলে’ (মুসলিম)। এই হল, আমাদের জন্য মহানবী (সা.) এর দিকনির্দেশনা, যা শুধু পাপ থেকেই মুক্ত রাখে না বরং মুক্তি এবং পরিত্রাণের বিধান এবং ব্যবস্থা হয় এবং আধ্যাত্মিকতায় উন্নত করে।

যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে, এক নামাজের পর পরবর্তী নামাজের কথা ভাববে, এটি হতেই পারে না যে, সে কোন ধরনের পাপে লিপ্ত হবে বা অন্যের ওপর জুলুম করা আরম্ভ করবে। আর কেউ যদি এমনটি করে তাহলে তার নামাজ, নামাজ নয় বরং সে সবচেয়ে বড় পাপে লিপ্ত। রমজান মাসের রোজার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম।

শাওয়াল মাসের রোজা সম্পর্কে হাদিসে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন হজরত আবু আয়ুব আনসারী (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রসুল করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখে এবং পরবতীর্তে (ঈদের দিন বাদ দিয়ে) শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখে সেক্ষেত্রে সে যেন গোটা বছরই রোজা রাখলো (মুসলিম)।

হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে হজরত ছাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রতিটি নেকি ১০ গুণ বৃদ্ধি করেন। সুতরাং রমজানের এক মাস রোজা রাখার দ্বারা ১০ মাস রোজা রাখার সাওয়াব হবে এবং ঈদুল ফিতরের পর ছয়টি রোজা রাখার দ্বারা পূর্ণ এক বছর রোজা রাখার সাওয়াব হবে’ (ইমাম নাসায়ী ফিস সুনানিল কুবরা)। অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে হজরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা রাখল, এরপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় গোনাহমুক্ত হয়ে গেল’ (আল মুজামুল আওসাত)।

হজরত আবু আইয়ুব (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল, এরপর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখল সে যেন এক যুগ (পূর্ণ বছর) রোজা রাখল’ (আবু দাউদ)।

এসব হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম শাওয়াল মাসের রোজার গুরুত্ব কত ব্যাপক। শুধু রোজা রাখলেই হবে না বরং প্রকৃত অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টির খাতিরে রোজা রাখতে হবে। নামাজ আর রোজার সমন্বয়ে মানুষের মাঝে খোদার নৈকট্য লাভের এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তা এভাবে যে, নামাজ আত্মাকে পবিত্র করে এবং রোজা হৃদয়কে আলোকিত করে। ফলশ্রুতিতে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি রোজা দ্বারা আধ্যাত্মিকতার এক নতুন রাস্তায় পরিচালিত হয়ে খোদার সন্তুষ্টির ছায়াতলে চলে আসে।

পবিত্র কোরআন বলে, রোজা তোমাদের মাঝে তাকওয়া অর্থাৎ খোদাভীতি সৃষ্টি করবে। এই তাকওয়া কিভাবে সৃষ্টি হবে? বস্তুতঃ রোজা এমন ইবাদত যা মানুষের প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ না রেখে কেউ রোজা রাখে তবে তা রোজা নয় বরং অন্য কিছু। খোদাভীতির সৃষ্টি এভাবেই হয় যে, মানুষ খোদার সন্তুষ্টির জন্য নিজের মন মেজাজ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে খোদার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে তার অবাধ্য আত্মা নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ঐ সকল কর্ম হতে সে দূরে সরে পড়ে যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসন্তুষ্টির কারণ হয়।

মহানবী (সা.) শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজার কথা উল্লেখ করে এর গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন, রমজানের ৩০ টি ও শাওয়ালের ৬টি মোট ৩৬ টি রোজা যে রাখবে সে যেন সারাটা বছর রোজা রাখার সওয়াব পেল।

আমাদের সবার উচিত হবে, শাওয়াল মাসের ৬টি রোজা রাখার চেষ্টা করা। এছাড়া রমজানের দিনগুলো যেভাবে বিশেষ ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়েছি বছরের বাকি দিনগুলোও যেন সেভাবে কাটানোর চেষ্টা করি। আমাদের সবাইকে আল্লাহ ও তার বান্দার অধিকার আদায় করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

১৪,২০২২ at ১০:৩৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/রানি/রারি