ইউক্রেন থেকে ২৮ নাবিককে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া, দৌলতপুরের সেতুর পরিবারে স্বস্তি

ইউক্রেনে আটকাপড়া জাহাজের নাবিক কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ফয়সাল আহমেদ সেতু। ফাইল ছবি।

ইউক্রেনে চলমান রাশিয়ার সামরিক অভিযানের ঘটনায় দেশটির অলিভিয়া সমুদ্র বন্দরে আটকাপড়া বাংলাদেশি জাহাজের ২৮ জন নাবিককে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের রোমানিয়া হয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। জাহাজটিতে আটকাপড়া নাবিকদের মধ্যে একজনের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের সালিমপুর ঈদগাহপাড়া গ্রামে। তার নাম ফয়সাল আহমেদ সেতু (২২)। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বৃহস্পতিবার রাতে নাবিকদের মোটামুটি নিরাপদে পৌঁছানোর খবর পেয়ে সেতুর পরিবারে খানিকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না তারা।

বুধবার (২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ২৫ মিনিটে ইউক্রেনের অলিভিয়া সমুদ্র বন্দরে থাকা পণ্যবাহী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর রকেট হামলা চালানো হয়। এতে জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। সমুদ্রের তীরে নোঙর করা জাহাজটি থেকে বাকি ২৮ জনকে ঘটনার পরের দিনেই (বৃহস্পতিবার) উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে রকেট হামলার শিকার জাহাজটিকে।

ফয়সাল আহমেদ সেতু জাহাজটির ডেক ক্যাডেট হিসেবে কর্মরত। তিনি দৌলতপুর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ বিশ্বাসের ছেলে। সেতু তার পরিবারকে জানিয়েছেন, তাদের সবাইকে জাহাজ থেকে মোটামুটি নিরাপদ একটি স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত একজন নিহত ছাড়া অন্য সবাই (২৮ জন) নিরাপদে রয়েছেন। তারা এখন ভালো আছেন বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান ফয়সাল আহমেদ সেতুর বাবা ফারুক আহমেদ বিশ্বাস ।

ফারুক আহমেদ বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, ছেলের জন্য আমাদের খুব ভয় হচ্ছিল। তবে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার খবর পেয়ে আমরা এখন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। কিন্তু অক্ষত অবস্থায় দেশে না ফিরে আসা পর্যন্ত পুরোপুরি দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছি না। তিনি বলেন, ছেলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেও কথা হয়েছে। তারা এখন ভালো আছে বলে জানিয়েছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকার সব ধরনের চেষ্টা করছে। তিনি আরো বলেন, আমার সঙ্গে শিপিং করপোরেশনের কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ বিশ্বাস জানান, গত চার মাস আগে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে তুরস্কে যান তার ছেলে ফয়সাল আহমেদ সেতু। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশ ঘুরে তাদের জাহাজটি ইউক্রেনে পৌঁছালে রকেট হামলার শিকার হয়। ইউক্রেন থেকে সিরামিকের কাঁচামাল নিয়ে জাহাজটি ইতালির উদ্দেশে যাওয়ার কথা ছিল।

ইউক্রেনে আটকাপড়া বাংলাদেশি জাহাজের নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সংগৃহীত ছবি।

এর আগে বৃহস্পতিবার ফয়সাল আহমেদ সেতু সংক্ষিপ্ত এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, এখন আমরা ভালো আছি। বর্তমানে আমাদের পর্যাপ্ত খাবার মজুত রয়েছে। কিন্তু দ্রুত সমস্যার সমাধান না হলে বিপদে পড়তে হবে। যে পরিমাণ খাবার মজুত রয়েছে তা অল্প কয়েক দিনেই শেষ হয়ে যাবে। খাদ্য শেষ হয়ে গেলে আমরা বড় বিপদে পড়তে পারি। এ ছাড়া জাহাজে পাওয়ার সাপ্লাই নেই। জরুরি পাওয়ার সাপ্লাই ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা বন্ধ হয়ে গেলে জাহাজে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে। তবে ২৪ ঘণ্টার আগেই আটকাপড়া বাংলাদেশি জাহাজের ২৮ নাবিককে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ায় তারাও কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন। তারা এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।

সেতুর মা মাকসুদা আহমেদ টলি বলেন, ছেলে জানিয়েছে সে ভালো আছে। তবুও ছেলের জন্য আমরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি। সবাই দোয়া করবেন আল্লাহ যেন সবাইকে বিপদমুক্ত রাখেন, নিরাপদে রাখেন। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় দিন কাটানো মাকসুদা আহমেদ বলেন, যত দ্রুত সম্ভব আমার ছেলেসহ অন্য সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।

ইউক্রেন হামলার শিকার হওয়া জাহাজ ‘এমভি বাংলা সমৃদ্ধি’র নাবিকদের মলদোভা হয়ে রোমানিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। শুক্রবার (৪ মার্চ) দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি বলেন, ইউক্রেন থেকে প্রথমে তাদের পাশের দেশ মলদোভা হয়ে রোমানিয়ায় নেয়া হবে। এরপর রোমনিয়া থেকে দেশে ফেরানো হবে। ইতোমধ্যে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এর আগে পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে আটকাপড়া বাংলাদেশি জাহাজটিতে থাকা ২৮ জন নাবিক ও ইঞ্জিনিয়ারকে ওই বন্দর থেকে দুই কিলোমিটার দূরের একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ওই জাহাজটিতে বুধবার রকেট হামলায় নিহত হওয়া ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহও একটি নিরাপদ হিমাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাহাজটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। হাদিসুর রহমানের মরদেহসহ এই ২৮ জনকে সীমান্ত পার করে পোল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন আরো জানান, বন্দরটির আশপাশের এলাকায় বাংলাদেশি অনেকে রয়েছেন। তাদের সহায়তায় এই উদ্ধার কাজটি দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে।

বৃহম্পতিবার রাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও গণমাধ্যমকে একই তথ্য জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইউক্রেনের শেল্টার হোম থেকে ২৮ বাংলাদেশি নাবিককে প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড হয়ে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় শুক্রবার নাবিকদের উদ্ধারের গতিপথ পরিবর্তনের কথা জানাল সরকার।

উল্লেখ্য, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরুর পর ইউক্রেনের অলিভিয়া সমুদ্র বন্দরে ২৯ সদস্য নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ আটকা পড়ে। সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে হাদিসুর রহমান আরিফ (৩৪) নিহত হন। দেশে ফিরে তার বিয়ে করার কথা থাকলেও ভাগ্যের নির্মম পরিণতির ফলে তাকে কফিনবন্দি হয়ে ফিরতে হবে।

মার্চ ০৪.২০২১ at ১৫:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরসে/রারি