সাংবাদিক নামের এরা কারা?

যশোরের অভয়নগরে সাংবাদিক পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কতিপয় যুবক। নাম সর্বস্ব পত্রিকা বা অনলাইনের কার্ড ঝুঁলিয়ে বেশ ঠাঁটে-বাটে ঘুরতে দেখা যায় এদের। সকাল থেকে রাত অবধি নওয়াপাড়া হাসপাতাল গেট, ক্লিনিকপাড়া, উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন কার্যালয়ে, দলিল লেখক সমিতির আশপাশে, থানা চত্বরে এমনকি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশের স্বনামখ্যাত বৃহৎ সারের মোকাম নওয়াপাড়ার অলিতে-গলিতে এদের বিচরণ করতে দেখা যায়। এদের বিরুদ্ধে মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা হাতানোর অভিযোগও রয়েছে।

এমনকি টাকা আদায়ের জন্য এ চক্রটি কোন তথ্য নেয়ার পরও সংবাদ পরিবেশন না করে দিনের পর দিন ফোন করে দেখা করার জন্য অতিষ্ঠ করে তোলে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজীর মামলাও হয়েছে। অনেকে অবশ্য ঝামেলা এড়াতে মামলা বা অভিযোগের দিকে না গিয়ে নিরবে অত্যাচার হজম করে আসছে।

এদের কারও কারও বিদ্যার দৌড় মাধ্যমিক পার করলেও অনেকে মাধ্যমিকের গন্ডিও পার হয়নি। সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়ে বেড়ালেও সংবাদ লেখার নূন্যতম ধারনা নেই অনেকের। যদিও এদের চাল-চলন, ঠাঁট-বাট ও কথা বার্তার ধরণ দেখে বোঝার উপায় নেই এরা আসলে কার্ডধারী মাত্র। উপরোন্ত কখনও কখনও জন সাধারণের কাছে প্রকৃত সাংবাদিকদের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় তাদের।

বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ প্রশাসন ও পত্রিকার সম্পাদকের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও তাদের ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে এরা সর্বমহলকে নাজেহাল করে চলেছে। এ চক্রের অনেকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজী, প্রতারণা, মারপিট ও যৌণ হয়রানীর অভিযোগ রয়েছে।

এর মধ্যে কারও কারও আবার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ হিসেবে পুলিশের খাতায় নামও রয়েছে। কেউ কেউ রয়েছে পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। কারও কারও বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগও রয়েছে। ইতিপূর্বে চাকুরী দেয়ার নামে এক কিশোরীকে ধর্ষন ও ধর্ষনের পর ভিডিও ধারণ মামলায় সাংবাদিক নামধারী এক প্রতারককে আটকের পর অনেকটা দমে যায় সাংবাদিক নামধারী এ চক্রটি।

কিন্তু বর্তমানে পুণরায় গাঁ-ঝাড়া দিয়ে দেদারছে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। স্থানীয়রা অবশ্য এদেরকে সামনে না বললেও পেছনে সাংবাদিক না বলে সাংঘাতিক বলে গালি দেয়। অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একাধিক চিকিৎসক এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, কতিপয় সাংবাদিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিবো নাকি রোজ রোজ এ তথ্য সে তথ্য দিবো। কখনও একটা সংবাদ পরিবেশন করতে দেখা না গেলেও রোজ এসে নানা তথ্য চেয়ে বসে থাকে। আর এমন সব আজগুবি প্রশ্ন করে বসে যা রীতিমত হতভম্ব করে দেয়।

আর সেই সাথে থাকে নানা ফরমায়েশ আর সুপারিশ। একটু এদিক-ওদিক হলেই হম্বি-তম্বি করে এরা হাসপাতাল মাথায় করে ফেলে। ফলে দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগীদেরও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। কেউ কেউ নানা ব্যস্ততার মাঝে রোজ আসেন ছবি তুলতে যা রোগী ও স্বজনদের বিড়ম্বনায় ফেলে।

বেশ কয়েকজন ক্লিনিক মালিকের অভিযোগ, মাঝে মাঝে যশোরের সিভিল সার্জন বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা ক্লিনিক পরিদর্শনে আসলে ওই চক্রের সদস্যরাও খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে যায়। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ওই কর্তাদের সাথে কথা বলে’। পরবর্তীতে দু এক দিন না যেতেই সাংবাদিক পরিচয়ধারী ওই চক্রের সদস্যরা প্রতিষ্ঠানে এসে বলে ‘আপনাদের পক্ষে বলে দিয়েছি আমাদের দিকে খেয়াল রাখবেন। না হলে কিন্তু সিভিল সার্জনকে বলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করিয়ে দিবো।”

আর কোন ত্রুটি বা অপরাধে সিভিল সার্জন বা ভ্রাম্যমান আদালত কোন ক্লিনিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এ চক্রের সদস্যরা পাশের ক্লিনিকগুলোতে যেয়ে খুব দম্ভের সাথে বলে, “ ওমুক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কিন্তু খারাপ করে দিয়েছি। এবার আপনাদেরটাও একই অবস্থা হবে।”

আরো পড়ুন :
এক শিমুল গাছের রহস্য: কোপ মারতেই ঝরে রক্ত
২৭ জানুয়ারি, ২০২২ : সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবসের শতবর্ষ

অভয়নগর উপজেলার একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের অভিযোগ, হুট হাট করে প্রতিষ্ঠানে এসে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এরা বিভিন্ন খাতা-পত্র টানাটানি করে। কখনও কখনও এমন সব অবান্তর প্রশ্ন করে যা অবাক করে দেয়। খুব স্টাইলের সাথে ক্যামেরা ধরে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে থাকে। পরে একটি মোবাইল নম্বর ধরিয়ে দিয়ে এ ত্রুটি সে ত্রুটি বলে পরে মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে দেখা করতে বলে। দেখা না করলে নিউজ করে চাকরি খাওয়ারও হুমকি দেয়।

অনেকে সাংবাদিক বলে ঝামেলায় না গিয়ে ৫শ’ হাজার টাকা পকেট থেকে দিয়ে বিদায় করে দেন। সম্প্রতি নওয়াপাড়া সারের মোকামের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ীর কাছে হাত খরচের টাকা চেয়ে না পেয়ে একটি নাম স্বর্বস্ব অনলাইনে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য কৃষি কর্মকর্তা পরিদর্শনে গিয়ে ওই সংবাদের কোন সত্যতা না পেয়ে ফিরে আসেন। এভাবে চক্রটি দিনের পর দিন মানুষকে হয়রানী করে আসছে।

এ ব্যাপারে নওয়াপাড়া প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক ও দৈনিক কালের কন্ঠের অভয়নগর প্রতিনিধি সৈয়দ জাহিদ মাসুদ তাজ বলেন, সমাজে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত কতিপয় সাংবাদিক নামধারী ব্যক্তির জন্য সাংবাদিকতার মহান পেশা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। কখনও কখনও প্রকৃত সাংবাদিকরাও এখন সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। আবার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও ভুঁইফোড় নানা সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। এবং প্রশাসনকে বিপাকে ফেলার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। যে কারনে এদের দৌরত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে যেকোন উপায়ে এদের থামানো না গেলে ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে মহান এ পেশাটি। এ ব্যপারে অভয়নগর থানার অফির্সাস ইনর্চাজ একেএম শামীম হাসান বলেন, মাঝে কিছু অপ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছিলাম ইতি মধ্যে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একটি অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। সুষ্ঠ তনন্ত শেষে দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়া হবে।

এ বিষয়ে উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) তানজিলা আখতার জানান, সাংবাদিকদের উচিত সত্য সংবাদ পরিবেশন করা। না যেনে কোন সংবাদ গণমাধ্যমে পরিবেশন করা ঠিক না।

এ বিষয়টি নিয়ে কথা হলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ ফরিদ জাহাঙ্গীর বলেন, সাংবাদিতকা মহান পেশা। এই মহান পেশাটাকে কুলুসিত করা যাবে না। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করে প্রতিনিয়ত পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরে সমাজকে এগিয়ে নিতে হবে।

জানুয়ারি ২৬.২০২১ at ১৪:৩১:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/রানি/আক