বল্লী হাইস্কুলে নিয়োগ বাণিজ্য সফল করতে নিয়ম বহির্ভুতভাবে পকেট কমিটি গঠন চেষ্টার অভিযোগ

প্রধান শিক্ষক ও সহকারি প্রধান শিক্ষকসহ সাতটি পদে ৬০ লক্ষাধিক টাকা নিয়োগ বাণিজ্যকে সামনে রেখে সাতক্ষীরা সদরের বল্লী মো. মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে পকেট কমিটি গঠণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী, অবিভাবক ও শিক্ষকদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সাতক্ষীরা সদরের বল্লী মো. মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৬ সালে আমতলা গ্রামে ডা. শীতল প্রসাদ রায় এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও জায়গা সংকটের কারণে ওই বিদ্যালয়টি বল্লীতে স্থানান্তর করা হয়। দ্বিতল ভবনের নিচের অংশ নির্মাণ করে দেওয়ার পরে তার নামে মো. মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে নামকরণ করা হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম ওই বিদ্যালয়ে কয়েকবার আহবায়ক ও পূর্ণাঙ্গ কমিটির সভাপতি বা আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ফলগাছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল হকের দায়েরকৃত ২০৪০/১৯ নং রিট পিটিশনের শুনানী শেষে মহামান্য হাইকোর্ট ২০ ফেব্রুয়ারি এক ব্যক্তি একই প্রতিষ্ঠানে দু’বারের বেশি সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না-এমন নির্দেশনা দেওয়ায় বল্লী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বজলুর রহমান বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আহবায়ক হিসেবে ছয় মাস দায়িত্ব পালন করেন। ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসেবে মো. আব্দুর রাজ্জাক অবসরে যান।

তিনি দু’বছরের জন্য চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে গোলাম কাদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি আগামী ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাবেন। ২৫ সেপ্টেম্বর চার সদস্য বিশিষ্ট ছয় মাসের আহবায়ক কমিটির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান মুনজিতপুরের আব্দুস সেলিমের ছেলে মো. জিয়াউর বিন সেলিম ওরফে যাদু।

এরপর নতুন আহবায়কের সভাপতিত্বে ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম সভা, ১৮ অক্টোবর দ্বিতীয় ও ৮ নভেম্বর তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ওই বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপন অনুষ্ঠানে ওই কমিটির পক্ষ থেকে সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্যকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আগামি ২৫ মার্চ পর্যন্ত আহবায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠণের উদ্যোগ শুরু হয়। ২৩ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা, ২৮ ডিসেম্বর চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হয়।

কয়েকজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, প্রধান শিক্ষক, সহকারি প্রধান শিক্ষক, ডিজিটাল ল্যাব সহকারি, অফিস সহকারির সহায়ক, নৈশ প্রহরী, নিরাপত্তা কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে আগামীতে জনবল নিয়োগ করতে হবে এ প্রতিষ্ঠানে। এ নিয়োগের জন্য পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন আবশ্যক। একই সাথে গোলাম কাদের অবসরে যাওয়ার পর জ্যেষ্ঠতা ভেঙেও একজন সুবিধাজনক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া দরকার।

ওইসব শুন্যপদে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে পারলে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার বাণিজ্য হবে। সেকারণে আহবায়ক কমিটি গোপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পকেট কমিটি গঠন করে মো. জিয়াউর বিন সেলিম ওরফে যাদুকে সভাপতি বানাতে চান। এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ওই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক জামিল উজ জামান ও তিন বছর আগে দাতা সদস্য হিসেবে ২০ হাজার টাকা জমা দেওয়া আমতলার শাহীদুর রহমান দফাদার সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন।

এছাড়া ইনডেক্স এর জ্যেষ্ঠতা না মেনে ১৩টি নাশকতার মামলার আসামী দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর গ্লেবাল গাইড বুক কোম্পানীতে কাজ করে পরবর্তীতে দু’ জায়গা থেকে বেতন উত্তোলনকারি আজাহারুজ্জামান মুকুলের পরিবর্তে ফরিদপুরে দু’বছর কাজ করেও ইনডেক্স ঠিক রাখা অরুপ সাহা বা সহকারি শিক্ষক সিরাজুল ইসলাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে বসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সাথে জ্যেষ্ঠতা ভেঙে সহকারি শিক্ষক মো. জামিল উজ জামানকে সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে বসানোর চেষ্টা চলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অবিভাবক ও শিক্ষক জানান, পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠণের লক্ষ্যে আহবায়ক কমিটি খসড়া ভোটার তালিকা করে তা, শ্রেণিকক্ষে নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করা, পাঁচদিন পর সংশোধিত আকারে আহবায়ক কমিটির সভায় উপস্থাপন করা ও পরে চুড়ান্ত ভোটার তালিকা শিক্ষার্থীদের কাছে আবারো উপস্থাপন করার সরকারি নীতিমালা রয়েছে।

এ ছাড়া নির্বাচন সংক্রান্ত এলাকায় মাইকিং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও বিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে সেটে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একইভাবে ভোটার তালিকা চুড়ান্ত হওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে নিয়োগকৃত প্রিজাইডিং অফিসার নির্বাচন তপশীল তার অফিস বোর্ডে সেটে দেবেন এমনটি বলা হয়েছে।

অভিযোগ, গোপনে পকেট কমিটি গঠন করতে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা করে ১৪ জানুয়ারি নির্বাচন তপশীল, ১৫ জানুয়ারি নোটিশ বোর্ডে তপশীল সাঁটা, গোপন প্রক্রিয়ায় একটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ১৮ জানুয়ারি থেকে মনোনয়ন ফর্ম পূরণসহ সকল কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে আহবায়ক যাদুর বাসায় বা নিয়োগকৃত প্রিজাইডিং অফিসার সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অফিসে বসে।

সেক্ষেত্রে অফিস সহকারিকে শপথ করিয়ে খাতাপত্র বিদ্যালয় থেকে সাতক্ষীরায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাইকিং না করে, অধিকাংশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অবিভাবকদের ভোটার তালিকা সম্পর্কে অবহিত না করে, ভোটার তালিকা ও নির্বাচন তপশীল সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি নোটিশ বিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে না সেঁটে, প্রিজাইডিং অফিসারের অফিসের নোটিশ বোর্ডে নির্বাচন তপশীল না সেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মনোনয়ন ফর্ম পূরণ করে অবিভাবক বলাডাঙা গ্রামের জিয়ারুল ইসলাম শাহীন, আমতলার যুবলীগ নেতা আফতাবুজ্জামান লাল্টু, মুকুন্দপুরের গোলাম কবীর, রাজনগরের শামীম পারভেজ, মুকুন্দপুরের আবুল কাশেমের স্ত্রী লাকী খাতুন, শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে মো. আহসানউলহ, মো. জামিল উজ জামান ও সেলিনা খাতুনকে সদস্য হিসেবে স্বচ্ছ নির্বাচন ছাড়াই কমিটিতে চুড়ান্ত করা হয়েছে।

আরো পড়ুন :
শিবগঞ্জে মা গার্মেন্টস এন্ড এক্সপোর্ট গ্যালারী ২য় শাখার উদ্বোধন
৩৫ জনের ওমিক্রন শনাক্ত যবিপ্রবি ল্যাবে

একইভাবে আমতলার শাহীদুর দফাদারকে দাতা সদস্য হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। শনিবার থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করা হলেও আগামি রবিবার বা সোমবার এ পকেট কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শেষ করা হতে পারে।

এ ব্যাপারে ভাটপাড়ার রবিউল ইসলাম ও তার ১০ম শ্রেণিতে পড়–য়া ছেলে ফাহিম, রাজনগরের মাদ্রাসা শিক্ষক আজম ফারুখ ও তার ১০ম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে ছাদিয়া, রাজনগরের মফিজুল ইসলাম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে সুলতানা ও তার বাবা মফিজুল ইসলাম, বলÍীর রফিকুল ইসলাম ও তার ১০ম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে তুহিন শনিবার সকালে এ প্রতিবেদককে জানান, তারা ভোটার তালিকা ও নোটিশ বোর্ড, মাইকিং ও ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন সংক্রান্ত কিছুই জানেন না। একই কথা বলেন, শিক্ষক নাজিমউদ্দিন, আবুল হাসানসহ কয়েকজন।

ওই বিদ্যালয়ের পিওন আব্দুস সেলিম শনিবার সকালে জানান, তাদের নোটিশ বোর্ডটি অনেক আগেই সপ্তম শ্রেণিতে ব্লাকবোর্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

তবে শিক্ষক জামিল উজ জামান বলেন, তিনি সহকারি শিক্ষক হিসেবে প্রধান শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ি কাজ করে থাকেন। তার বাড়িতে বিদ্যালয়ের রেজুলেশন খাতাসহ অন্যান্য কাগজপত্র থাকে-এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেই তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, জামায়াত নেতা ১৩টি নাশকতার মামলার আসামী আজহারুজ্জামান মুকুল ব্যক্তি স্বার্থে বিএনপি নেতা এড. মোহিদকে সভাপতি বানেেত একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গোলাম কাদেরের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিদ্যালয় ছুটি হয়ে যায়। ফলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী না থাকলেও যথাযথ নিয়মে নতুন কমিটি গঠনের কাজ চলছে। বল্ল মো. মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম কাদেরের মোবাইল ফোনে যোগোযোগ করার চেষ্টা করলে তার ছেলে মোবাইল ফোন রিসিভ করে বলেন, তার বাবা অসুস্থতাজনিত কারণে ডাক্তারের কাছে গেছেন।

বল্ল মো. মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির আহবায়ক মো. জিয়াউর বিন সেলিম ওরফে যাদু বলেন, অবিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং রয়েছে। কয়েকটি নাশকতার মামলার আসামী আজহারুজ্জামান মুকুল যথাযথ প্রক্রিয়ার তাদের সুষ্ঠু কমিটি গঠনে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

বল্লী মো. মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসার সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ থাকলে অবিভাবকরা তার কাছে আসবেন। তার অফিসে নির্বাচন তপশীল সংক্রান্ত নোটিশ ঝোলানোর পর সময় পেরিয়ে যাওয়ায় তা তুলে ফেলা হয়েছে। তবে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফতেমা তুজ জোহরা বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানুয়ারি ২৩.২০২১ at ১৮:৪৭:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মৃরাঅ/রারি