জাতিসংঘের শান্তিরক্ষায় র‍্যাবের অংশগ্রহণ হুমকির মুখে!

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‍্যাব-এর অংশগ্রহণ হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের র‌্যাবকে শান্তিরক্ষায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ১২টি মানবাধিকার সংগঠন র‍্যাবকে নিষিদ্ধের আহ্বান জানানোর পর এ সংকট দেখা দেয়।

বছরের ৮ নভেম্বর জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যাঁ পিয়ের ল্যাক্রোইক্সকে চিঠি পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের জন্য মানবাধিকার বিষয়ক যে নীতি (দ্য হিউম্যান রাইটস স্ক্রিনিং পলিসি) গ্রহণ করা হয়েছিল তা বাংলাদেশিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রয়োগ করা হচ্ছে না। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ সেনা ও পুলিশ পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। ২০২০ সালে বিভিন্ন মিশনে ৬ হাজার ৭৩১ সদস্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বিগ্ন যে, যারা বাংলাদেশে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত তাদের অনেককে বিদেশে জাতিসংঘের মিশনে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করছে সরকার। নির্দিষ্ট করে বললে, জাতিসংঘের মিশনে পাঠানো অনেক বাংলাদেশিই র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‍্যাবের সদস্য।

অথচ বাহিনীটির বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও গুমের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিচেল ব্যাচেলেট বলেছেন, র‍্যাবের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অশোভন আচরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে। এর ভিত্তিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী দপ্তরের কাছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো আহ্বান জানিয়ে বলেছে, যাতে র‍্যাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল এমন সকল বাংলাদেশিকে জাতিসংঘের অধীনে নিয়োগ দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

চিঠিতে র‍্যাব নিয়ে কমিটি এগেইনস্ট টর্চারের ‘কনভেনশন এগেনইস্ট টর্চার’-এর কথা উল্লেখ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ২০১৯ সালে এক পর্যালোচনায় তারা বলে, র‍্যাবে চাকরি করছেন এমন ব্যক্তিদের প্রায়ই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে মোতায়েন করা হয়, যা উদ্বেগজনক।

এতে জাতিসংঘের কমিটি এগেইনস্ট টর্চার সুপারিশ করে, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী সব সামরিক এবং পুলিশ সদস্য, যাদেরকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে মোতায়েন করা হবে তাদের বিষয়ে যথাযথ একটি স্বাধীন যাচাই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারাই নিশ্চিত করবে যে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত কোনো ইউনিটের কোনো ব্যক্তি বা ইউনিটকে নির্বাচিত করা হয়নি।

আরো পড়ুন :
যেসব রোগে অধিক পেয়ারা খেলে হতে পারে ক্ষতি
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ষোষণা, সমাবেশে বিধিনিষেধ

মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্তদের জাতিসংঘ মিশনে মোতায়েন ঠেকাতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে ওই চিঠিতে। এর মধ্যে রয়েছে, জাতিসংঘকে এমন একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায় চালু করতে হবে যাতে করে শান্তিরক্ষী মিশনে নিয়োগ দেয়া কেউ র‍্যাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিনা তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। আরও বলা হয়, শান্তিরক্ষী মিশনের মোতায়েনের পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে সব সদস্যদের ব্যক্তিগত মানবাধিকার রেকর্ড যাচাইয়ের পদ্ধতি চালু করতে হবে।

এখন পর্যন্ত এ ধরনের যাচাই শুধু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্যই চালু রয়েছে। একইসঙ্গে যারা এই যাচাইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদের যথাযথভাবে সে উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কতটা স্বাধীনভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। কারণ এই কমিশনের উপরে রাজনীতির প্রভাব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর এর পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিলে তাদের রিপোর্ট প্রকৃত সত্য প্রকাশ করতে পারে না।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং অভিযোগগুলোর তদন্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। উল্টো যাদের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান প্রধান বেনজীর আহমেদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে ওই চিঠিতে। বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত র‍্যাবের প্রধান হিসাবে তার কাজের জন্য তাকে মেডেল দেয়া হয়েছে।

এই সময়কালে তার কমান্ডের অধীনে থাকা কর্মকর্তারা ১৩৬ জনকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করেছেন এবং ১০ জনকে গুম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হার্ভি ল্যাডসোস এ সময়ে তাকে ‘এক্সটারনাল রিভিউ অব দ্য ফাংশন্স, স্ট্রাকচার, অ্যান্ড ক্যাপাসিটি অব দ্য ইউএন পুলিশ ডিভিশনের’ একটি নিরপেক্ষ রিভিউ টিমে একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

চিঠির উপসংহারে গিয়ে বলা হয়, র‍্যাব সদস্যদের শান্তিরক্ষী মিশনে নিয়োগ এই বার্তাই দেবে যে- ভয়ানক মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও জাতিসংঘের অধীনে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব। এটি ভবিষ্যতে জাতিসংঘের ভাবমূর্তিকে হুমকিতে ফেলবে। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, এ ধরনের নিয়োগ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে। সংগঠনগুলো এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে সরাসরি বৈঠকে বসার আহ্বানও জানায় চিঠিতে।

জাতিসংঘের কাছে লেখা ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারী মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো হলো- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ান্সেস, এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড এলায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস, দ্য এডভোকেটস ফর হিউম্যান রাইটস ও ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার।

জানুয়ারি ২১.২০২১ at ১৫:১৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/রানি/রারি