পাবনায় সুচিত্রা সেনের অষ্টম প্রয়াণ দিবস পালন

পাবনায় বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের অষ্টম প্রয়াণ দিবস পালন করা হয়েছে। দিনটি পালনে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ পুষ্পামাল্য অর্পণ ও স্মরণ সভার আয়োজন করে। সোমবার সকাল ১১টায় পাবনা শহরের হেমাসাগর লেনে পৈত্রিক বাড়িতে সুচিত্রা সেনের ম্যুরালে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা। পরে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণসভা। স্মরণসভার শুরুতে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সদ্য প্রয়াত সভাপতি সাইদুল হক চুন্নুর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়।

সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. নরেশ মধুর সঞ্চালনায় স্মরণসভায় বক্তব্য দেন, পাবনা প্রেসক্লাব সভাপতি এবিএম ফজলুর রহমান, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ড. মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিনয় জ্যোতি কুন্ডু, সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক সরোয়ার উল্লাস, ওসাকার পরিচালক ও পরিষদের সদস্য মাজহারুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক কর্মী শিশির ইসলাম, অঞ্জলি ভৌমিক, আনিকা তাসনিম প্রমুখ।

সভায় সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়ি উদ্ধারের ১২ বছর পর হলেও বাড়িটিতে স্মৃতি সংগ্রহশালা গড়ে না ওঠায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তারা বলেন, বাড়িটিতে এখনও সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা করার কোনো কাজ হয়নি। দিনে দিনে বিষয়টি স্তিমিতি হয়ে পড়েছে।

জেলা প্রশাসন থেকে আজকের দিনে কোনো আয়োজন না করায় নিন্দা জানিয়ে বক্তারা বলেন, এখন আবার আন্দোলনের সময় এসেছে। বাড়িটি উদ্ধারে যেমন আন্দোন সফল হয়েছিল, ঠিক সেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে বাড়িটিতে সংগ্রহশালা করার আন্দোলনে নামতে হবে। দ্রুত স্মৃতি সংগ্রহশালার কাজ শুরু করে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারের প্রতি আহবান জানান সাংস্কৃতিক কর্মীরা।

১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা জেলায় জন্ম নেন এই দীপ্তিময় প্রতিভা। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের একতলা পাকা পৈত্রিক বাড়িতে সুচিত্রা সেনের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তার বাবা করুনাময় দাশগুপ্ত পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারী ইন্সপেক্টর পদে চাকুরী করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিনী। দু’বোনের মধ্যে সুচিত্রা সেন ছিলেন বড়। ছোট বোন হেনা দাশগুপ্ত।

শহরের মহাকালী পাঠশালায় পড়ালেখা শেষ করে সুচিত্রা সেন স্থানীয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগী ও মেধাবী না থাকলেও গান, নাটক, অভিনয় প্রিয় ও পছন্দের ছিল সূচিত্রা সেনের। পাবনা শহরের নানা অনুষ্ঠানে গান গাওয়া ও নাটক থিয়েটারে তিনি অভিনয়ে দক্ষতা দেখান।

উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সুচিত্রা সেন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ক’মাস আগে বাবা করুণাময় দাসগুপ্ত পাবনার বাড়ি-ঘর, চাকুরী সবকিছু ফেলে স্বপরিবারে ভারত পাড়ি দেন। কলকাতা যাবার বছর দু’য়েক পরেই সেখানকার বনেদি পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সাথে রমাদাশগুপ্তের বিয়ের পর নাম হয় সুচিত্রা সেন। আর বিয়ের পর স্বামীর পদবীতে রমাদাশগুপ্ত হয়ে যান রমা সেন। সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেনের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশেরই দক্ষিণ অঞ্চলে।

পাবনার উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রমা বনেদি পরিবারের বধু হয়ে ঘর সংসারের পাশাপাশি সিনেমায় অভিনয়ে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে “শেষ কোথায়” নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। অজ্ঞাত কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি।

এরপর ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবি “সাত নম্বর কয়েদি” ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন একটানা বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেন। স্বামী দিবানাথ সেনের প্রবল আপত্তি থাকলেও সুচিত্রা সেন মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িয়ে রাখেন। ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। তারই একজন সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় এ ছবিতে অভিনয় করার পর ছবি মুক্তির সময় রমা নাম বদলে নাম দেন ‘সুচিত্রা সেন’।

এরপর থেকেই কিশোরী বেলার বান্ধবিদের রমা বাবা-মায়ের দেওয়া নাম রমা দাশগুপ্ত থেকে স্বামীর পদবী নিয়ে রমা সেন সবশেষে স্বপ্নসুন্দরী সুচিত্রা সেন হয়ে যান। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও ৭টি হিন্দি মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে জুটি হয়ে বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন। ১৯৭৮ সালে উত্তম কুমার মারা গেলে সিনেমায় অভিনয় বন্ধ করে দেন।

১৯৬৩ সালে সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন সিলভার প্রাইজ ফর বেষ্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ভারত সরকারও তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করেন।

আরো পড়ুন :
তৃতীয়বারের মতো হাল ধরলেন আইভী
ইউপি নির্বাচনে স্বামী, স্ত্রী ও বাপ, ছেলের লড়াই

২০০৫ সালে তাঁকে দাদা সাহেব ফলকে পুরস্কার দেয়ার প্রস্তার রাখলে তিনি জনসমক্ষে আসতে চাননি বলে তা গ্রহন করেননি। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্Ÿোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণ দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি দেবদাস ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন, যা ছিলো তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কোলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

সূচিত্রা সেনের অভিনীত চলচ্চিত্র নিয়ে বিগত কয়েক দশক ধরে উৎসব করে আসছে পাবনার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই উদ্যোগ সূচিত্রা সেনকে চিরঞ্জীব রাখবে বলে মনে করা হয়। প্রতি বছর যখন এই উৎসব আয়োজন করা হয়।

২০০৯ সাল থেকে পাবনায় শুরু হয় সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব। সূভাষ দত্ত, কবরীসহ বহু নামী দাবী শিল্পী ঐ সময় পাবনায় আসেন। এর পর থেকে একে চিত্রনায়ক ফারুক, আলমগীর, নায়ক রাজ রাজ্জাক, নায়িকা সুজাতা, রোজিনা, চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, নায়ক উজ্জ্বল, নায়িকা দিতিসহ নবীন ও প্রবীণ নায়ক নায়িকারা এই উৎসবে আসেন।

সর্বশেষ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও পাবনা জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এবং সূচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সহায়তায় ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সূচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি আয়োজনে এই উৎসব পালন সূচিত্রা সেন ও পাবনার ভাবমুর্তিকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। তবে করোনার কারণে গত দুই বছর তেমন কোন কর্মসুচি পালন সম্ভব হয়নি।

জানুয়ারি ১৭.২০২১ at ১৫:১০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/মিতা/রারি