অবশেষে শপথ নিলেন দৌলতপুরের সেই বিতর্কিত চেয়ারম্যান

জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলকে শপথবাক্য পাঠ করান।

হাইকোর্টের আদেশে শপথগ্রহণ স্থগিত হয়ে যাওয়া কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের সেই বিতর্কিত চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল অবশেষে শপথগ্রহণ করেছেন। বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ওই ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্বাচনী ফলাফলের বিপক্ষে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করায় নির্বাচন কমিশনের গেজেটভুক্ত এই চেয়ারম্যানের শপথ স্থগিত করা হয়।

দৌলতপুর উপজেলার অপর ১৩ ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের গত ৬ জানুয়ারি শপথগ্রহণের দিনেই সিরাজ মণ্ডল তার ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ স্থগিতের আপিল আবেদন করেন। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেড ডিভিশন তার আবেদন আমলে নিয়ে রিট আবেদনের স্থগিতাদেশ দেন এবং আগামী ৬ মাসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য জেলার নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আদেশ দেন। আপিল বিভাগের এই স্থগিতাদেশের ফলে নানা কারণেই আলোচনায় থাকা চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের শপথগ্রহণে যে আইনি বাধা ছিল তা দূর হয়ে যায়। জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে তার নিজ কার্যালয়ে চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলকে শপথবাক্য পাঠ করান।

গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে দৌলতপুর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের ৪টি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) ৯টি এবং স্বতন্ত্র হয়ে অংশ নেয়া বিএনপি ১টিতে জয়লাভ করে। এদের মধ্যে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের নির্বাচনে ফলাফলের বিপক্ষে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদ মনোনীত মশাল প্রতীকের প্রার্থী আজিজুল হক। তার রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টের এক আদেশে নির্বাচন কমিশন থেকে গেজেটভুক্ত হওয়া চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের শপথগ্রহণ স্থগিত করা হয়।

ওই পিটিশনের আওতায় পড়া রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল ৭ হাজার ৯৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদের আজিজুল হক মশাল প্রতীকে পান ৬ হাজার ৮২৬ ভোট। তাদের ভোটের ব্যবধান দাঁড়ায় ২৬৮। রিট পিটিশনে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ১, ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটের ফলাফলের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ওই তিনটি ওয়ার্ডের ভোট পুনর্গণনার জন্য আবেদন করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি মামনুন রহমান ও খন্দকার দেলোয়ারুজ্জামানের বেঞ্চ বিষয়টি আমলে নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে সিরাজ মণ্ডলকে গেজেটভুক্ত না করার আদেশ দেন। কিন্ত হাইকোর্টের সেই আদেশের কপি নির্বাচন কমিশনে পৌঁছাতে বিলম্বিত হওয়ায় আদেশ জারির পাঁচদিনের মাথায় গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত গেজেটে সিরাজ মণ্ডলের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে হাইকোর্ট ডিভিশনের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের শপথ স্থগিত করেন।

অন্যদিকে শপথগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হওয়া রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল নির্বাচনে তার বিজয়ী হওয়ার রেজাল্টশিট অনুযায়ী গত ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেড ডিভিশনে আপিল আবেদন করেন। তিনি হাইকোর্টের দেয়া আদেশের স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করায় আপিল বিভাগ তা আমলে নেন। আপিল বিভাগ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের অনিয়ম প্রতিকারের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গঠন করে দেয়া ট্রাইব্যুনালকে শুনানির মাধ্যমে আগামী ১৮০ দিনের (৬ মাস) মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আদেশ দেন। সংশ্লিষ্ট জেলার সিনিয়র সহকারী জজকে নিয়ে ‘নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল’ এবং যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে ‘নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা হয় বলে জানা যায়।

নির্বাচনী ফলাফলের বিপক্ষে রিটকারী জাসদ প্রার্থী আজিজুল হক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশ অমান্যের অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, গত ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট নির্বাচনী ফলাফলের গেজেটসহ অন্যান্য কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন এবং পুনরায় ভোট গণনার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে গত ১৮ ডিসেম্বর গেজেট প্রকাশ করা হয়। পরে এ ব্যাপারে আদালতের আদেশের কপিসহ নির্বাচন কমিশনের কাছে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে লিখিতভাবে আবেদন করা হলে তারা নড়েচড়ে বসেন। এটি নির্বাচন কমিশনের আদালত অবমাননার শামিল বলেও মন্তব্য করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আজিজুল হক।

উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা গোলাম আজম জানান, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের শপথগ্রহণে বাধা না থাকায় তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আজিজুল হকের রিট আবেদনে যে তিনটি ওয়ার্ডে ভোটের অসঙ্গতির বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে সে বিষয়টি নির্বাচন কমিশন গঠিত ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হবে। ভোট পুনর্গণনা করা হবে কিনা সেটি এই ট্রাইব্যুনাল নির্ধারণ করবে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই।

আরো পড়ুন:
রাজশাহী মহানগরীতে ১৯৯০ পিচ ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটসহ ২ জন গ্রেফতার
যশোর শহরে ৩৫০ মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করলেন মেয়র পলাশ

গত ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দৌলতপুর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের বর্তমান চেয়ারম্যানরা পুনরায় মনোনয়ন পান। পাঁচ বছরে তাদের অনেকেই নানা কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়ায় তারা নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হন। বর্তমান চেয়ারম্যানদের মধ্যে ১০ জনই ব্যাপক ভরাডুবির শিকার হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চারজন জয়ী হলেও তাদের মধ্যে সিরাজ মণ্ডলের বিপক্ষে রিট পিটিশন করায় হাইকোর্টের আদেশে তারও শপথগ্রহণ আটকে যায়। পরে অ্যাপিলেড ডিভিশনে চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের আপিল আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া আদেশে স্থগিতাদেশ দেন।

প্রসঙ্গত, গত পাঁচ বছরে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডলের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। নানা খামখেয়ালি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি পুরো উপজেলাব্যাপী চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েন। নির্বাচনের কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের এক সমাবেশে তিনি দলের এই শীর্ষ নেতার ভুল নাম সংবলিত ব্যানার নিয়ে শোডাউন করতে গিয়ে সমালোচনার শিকার হন। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে জাতীয় ও দলীয় পতাকার সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন করেও ব্যাপক সমালোচিত হন চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল।

জানুয়ারী ১৩.২০২২ at ১০ ২১:৫২:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এআস/জআ