যশোরে একের পর এক খুন, সাধারন মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে

যশোরে একের পর এক খুনে মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে যশোরে একের পর এক খুনের ঘটনায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে মানুষের মধ্যে। তুচ্ছ ঘটনায় এবং স্থানীয় আধিপত্য দ্বন্দ্বে হত্যাকান্ডগুলো ঘটে যাচ্ছে। বিশেষ করে যশোর সদর উপজেলায় চিহ্নিত প্রতিপক্ষ ও পরিচিতজনদের হাতে খুনগুলো হচ্ছে। দু’মাসে ৫ খুনের পর ৮ জানুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে তৃতীয় লিঙ্গের একজন খুন ও ১০ জানুয়ারী সন্ধ্যায় অভয়নগরে সুন্দলী ইউনিয়নের নব নির্বাচিত মেম্বরকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শঙ্কাা আরও বেড়েছে।

ক্রাইম ঘটিয়ে সহজেই পালিয়ে যাওয়া যাবে এমন ধারণা থেকেই অপরাধীরা এসব ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী ও নিহতদের স্বজনদের দাবি। পুলিশি টহল বৃদ্ধি, সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের নতুন তালিকা করে আটকের দাবি তাদের। একই সাথে ভূক্তভোগী পরিবারের লোকজন এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চ মহলের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ৫ খুন এবং চলতি জানুয়ারির শুরুতেই যশোর সদর উপজেলায় আরও একটি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

কলেজ ছাত্র, স্কুল ছাত্র, ইজিবাইক চালক, দোকানী, রাজনৈতিক ঘরানার যুবক এবং তৃতীয় লিঙ্গের একজন খুন হওয়ার ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা ও অপরাধ প্রবনতা নিয়ে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ৮ জানুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে আধিপত্য ও পূর্ব শত্রুতার কারণে ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করে খুন করা হয়েছে ধর্মতলা এলাকায় বসবাস করা আব্দুল কাদের ওরফে লাভলী নামে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে।

তিনি যশোরের বেজপাড়ার করিম মিস্ত্রীর ছেলে। তৃতীয় লিঙ্গের লাভলী খুনের ঘটনায় জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবি ৪ জনকে আটক ও তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, একটি বার্মিজ চাকু, একটি করাত ও ২টি মোবাইল ফোনসেট উদ্ধার করে। আটক ও উদ্ধারের পর তথ্য মিলেছে, তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) সম্প্রদায়ের আধিপত্য বিস্তার ও টাকা লেনদেনকে কেন্দ্র করে অপর তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি সেলিনা ও নাজমার সাথে আব্দুল কাদের ওরফে লাভলীর মধ্যে অভ্যন্তরীন বিরোধের সৃষ্টি হয়।

সে কারণে নাজমা ও সেলিনাসহ তাদের সহযোগী আরওা কয়েকজনকে নিয়ে লাভলীকে খুন করার পরিকল্পনা করে। এরপর ৮ জানুয়ারি সকালে লাভলী একটি বাচ্চা নাচানোর উদ্দেশ্যে কায়েমকোলা বাজারের দিকে যান। এসময় তার সহযোগী হিসেবে নাজমা ও সেলিনা ছিলেন। নাজমা ও সেলিনার পূর্ব পরিকল্পনায় ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে একটি ইজিবাইকে করে রওনা করেন।

হালসা গ্রামের মাঠে একটি ব্রিজের উপর পৌছানো মাত্র নাজমা, সেলিনা, শাকিল পারভেজ ও মেহেদী হাসানসহ অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজনে তাদের পথরোধ করে। এরপর প্রথমে পিস্তল দিয়ে লাভলীকে লক্ষ্য করে পরপর দু’টি গুলি করে। পিস্তলের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে লাভলীকে হত্যা করা হয়। আর এই হত্যকান্ড ঘটে প্রকাশ্য দিবালোকে। সেখানে ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে সদর উপজেলার দোগাছিয়া গ্রামের জিয়াউর রহমানের ছেলে শাকিল পারভেজ (২১), ঝাউদিয়া গ্রামের শাহাজুল বিশ্বাসের ছেলে মেহেদী হাসান (১৯) আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে।

অভয়নগরে নবনির্বাচিত ইউপি মেম্বার উত্তম সরকার হত্যাকান্ডে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ নিহতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনার পর এলাকাবাসীর মধ্যে চরম আতংক বিরাজ করছে। পুলিশের একাধিক টিম রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকারীদের আটকে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

সোমবার (১০ জানুয়ারি) রাত ৮টার দিকে অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত মেম্বর উত্তম সরকার হরিশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। তিনি হরিশপুর গ্রামের মৃত প্রশান্ত সরকারের ছেলে। ২৬ ডিসেম্বর ইউপি নির্বাচনে ফুটবল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন তিনি।
সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে সুন্দলী ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামে নিহত উত্তম সরকারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, শ’শ’ মানুষ ভিড় করেছেন।

টিনের চালা দেয়া বাড়ির বারান্দায় বসে নিহতের মা, স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান অঝোরে কাঁদছে। নিহতের মা শেফালী সরকার বলেন, ‘নির্বাচন করায় আমার ছেলের আজ এই অবস্থা হয়েছে। তার বুকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। এখন উত্তমের দুই শিশুর কী হবে?

নিহতের স্ত্রী শ্রাবন্তী সরকার বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে খুন করা হয়েছে। খুনের পরিকল্পনাকারী ও খুনিদের আইনের আওতায় এনে দুষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ’।

সুন্দলী ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, ‘এভাবে একজন নির্বাচিত মেম্বারকে বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা ইউনিয়নের জন্য শুভ লক্ষণ হতে পারে না। ঘটনার পর থেকে গ্রামবাসীর মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। তবে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে’।

অভয়নগর থানার ওসি একেএম শামীম হাসান জানান, নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোন অভিযোগ না করায় মামলা হয়নি। তবে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। হত্যাকান্ড উৎঘাটনে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।

এর আগে ১৯ ডিসেম্বর দুপুরে যশোরের শংকরপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সাব্বির হোসেন নামে এক চা দোকানীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। তারই পূর্ব পরিচিত উঠতি সন্ত্রাসীরা তাকে কৌশলে ডেকে হত্যা করে।

এর আগে ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরতলী বকচর হুঁশতলা কবরস্থানপাড়ার মৃত লিটু সরদারের ছেলে রাকিব সরদারকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। বকচর মোড়ে একটি ভাঙাড়ির দোকানে কাজ করা রাকিব এদিন সন্ধ্যায় মাঠপাড়ার শহিদুল ইসলামের চটপটির দোকানে চটপটি খেতে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে রাকিব বন্ধুদের সাথে চটপটি খাচ্ছিলেন। এ সময় এলাকার পরিচিতরা আধিপত্য দ্বন্দ্বে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে।

১৭ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০ টায় কবরস্থান এলাকার নরায়ণ চন্দ্র ঘোষের চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় আব্দুল হামিদের ছেলে সাবেক সৈনিক ও তাঁতীলীগ নেতা কাকনকে। ঘটনার ব্যাপারে পরিবারের পক্ষে বলা হয় একদল অজ্ঞাত পরিচয়ের সন্ত্রাসীরা তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।

৯ নভেম্বর রাতে শহরতলী সুলতানপুরের মুজাদ্দুজ্জামানের ছেলে কলেজ ছাত্র ও ইজিবাইক চালক আব্দুল্লাহকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। ইজিবাইকটি ছিনতাইয়ের জন্যই ছিল ওই খুন। খুনীদের মধ্যে একজন ছিল নিহতের অতি পরিচিত।

আরো পড়ুন :
তিনজনের ওমিক্রন শনাক্ত, মোট ৩৩
ভোলায় স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে স্বামীর পরকিয়া প্রেমিকা আটক

পুলিশি তদন্ত ও খোঁজ খবর নিয়ে তথ্য মিলেছে হত্যাকান্ডগুলো ঘটেছে ছোটখাটো পূর্ব ঘটনা নিয়ে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও তুচ্ছ স্বার্থ নিয়ে। উঠতি দুর্বৃত্ত ও অস্ত্রধারীরা একের পর এক এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনের দাবি জড়িতরা এলাকারই। তারা রাজনৈতিক সেল্টারে চলে বলে পরিচয় দেয়।

অস্ত্রধারী হওয়ায় ওই সব চক্রকে মানুষ ভয় পায়। হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ফেললেও তারা যে কী ধরণের অপরাধ ঘটিয়েছে সে বোধও যেনো তাদের নেই। এ ব্যাপারে জোরালো পুলিশি টহলের দাবি তাদের।

এছাড়া উঠতি সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের নতুন তালিকা করে আটকের দাবি উঠেছে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়দের পক্ষ থেকে। গেল কয়েক বছরে যশোরের বিভিন্ন স্পটে একাধিক গ্রুপ করে উঠতি সন্ত্রাসীরা মাথা চাড়া দিয়েছে। যারা তুচ্ছ একটি ইজবাইক, ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়, কিংবা নেপথ্যে থাকা কোনো রাজনৈতিক নেতার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে হত্যার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে পুলিশকে কৌশলী কার্যক্রম হাতে নেয়ার ব্যাপারে কথা বলছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

এ ব্যাপারে যশোর কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, হত্যাকান্ডগুলো ঘটে যাচ্ছে বিছিন্নভাবে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অপরাধী চক্র অপরাধ ঘটাচ্ছে। পুলিশি টহল জোরদার রয়েছে।

এছাড়া হত্যাকান্ডগুলোর ব্যাপারে যত্নসহকারে তদন্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। অধিকাংশ হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন হয়েছে। সব আসামি আটক করে চালান দেয়া হয়েছে। কয়েকটি হত্যা মামলার আসামিরা আত্মগোপনে আছে। সোর্স লাগিয়ে আটকের চেষ্টা চলছে। তবে হত্যাকান্ড কিংবা অপরাধ যাতে না ঘটে সে চেষ্টা রয়েছে পুলিশের।

এ ব্যাপারে যশোর জেলা গোয়েন্দা শাখার অফিসার ইনচার্জ রুপন কুমার সরকার জানিয়েছেন, গোয়েন্দা শাখা অপরাধ প্রতিরোধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। টহলও জোরদার ও অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডগুলোর ব্যাপারে দ্রুততম সময়ে অ্যাকশানে গিয়ে রহস্য উন্মোচনসহ জড়িতদের শনাক্ত ও আটক করা হয়েছে। এছাড়া গোয়েন্দা শাখা আরও আন্তরিকভাবে কাজ করবে অপরাধ দমনে।

জানুয়ারি ১২.২০২১ at ২১:৫৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/শজ/রারি