একাত্তরের এই দিনে দৌলতপুর যেভাবে শত্রু মুক্ত হয়

দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরে অবস্থিত স্মৃতিস্তম্ভ -ফাইল ছবি।

৮ ডিসেম্বর দৌলতপুর উপজেলা শত্রু মুক্ত হওয়ার দিন। একাত্তরের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল কুষ্টিয়ার এই উপজেলা। উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা। ভারতীয় সীমান্তবর্তী দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে দীর্ঘ ৯ মাসে উপজেলার ধর্মদহ ব্যাঙগাড়ি মাঠ, শেরপুর, বোয়ালিয়া, প্রাগপুর, হোসেনাবাদ, গোয়ালগ্রাম, আল্লারদর্গা, মহিষকুণ্ডি ও বড়গাংদিয়ায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মুখযুদ্ধসহ ছোটবড় ১৬টি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এসব যুদ্ধে ৩৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং কয়েকশ নারী-পুরুষ শহীদ হন। নিহত হন পাকবাহিনীর শত শত সৈন্য।

৮ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পাকস্তানি বাহিনীর সদস্যরা পিছু হটতে বাধ্য হন। ১৯৭১ এর আজকের এই দিনে দৌলতপুর উপজেলার আল্লারদর্গা বাজারের শেষপ্রান্তে বর্তমানে নাসির টোব্যাকোর সামনের এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে সর্বশেষ শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম। সেই যুদ্ধের একপর্যায়ে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী তাদের গোলাবারুদ ট্যাংক বহর নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর দৌলতপুরকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন ৮ নম্বর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নুরুন্নবী। উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের বিজয় পতাকা।

দৌলতপুরে পাক হানাদারদের সাথে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ ব্যাঙগাড়ি মাঠে। ৯ নভেম্বর থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিনদিন ধরে এই যুদ্ধ চলে। সেখানে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ২ জন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্য শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৬০০ সৈন্য নিহত হন। মুক্তিবাহিনীর রণ কৌশল বুঝতে না পেরে রাতের অাঁধারে পাকবাহিনীর সদস্যরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিপক্ষ মুক্তিবাহিনী ভেবে নিজেদের মধ্যেই গোলাগুলিতে লিপ্ত হন। এ কারণে পাকবাহিনীর শত শত সৈন্য মারা যান। ১১ নভেম্বর সকালে তাদের লাশের স্তুপ কয়েকটি ট্রাকে করে কুষ্টিয়া শহরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

২৫ নভেম্বর আরেকটি বৃহৎ গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয় দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুর গ্রামের মঙ্গলপুর মাঠে। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন কুষ্টিয়া ই-৯ এর গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ও ডেপুটি কমান্ডার জলিলুর রহমান। সেদিন রাতে গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান প্রায় ১০০ জন সুসজ্জিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে শেরপুর গ্রামের সেনপাড়ায় অবস্থান করেন। বিষয়টি পাকবাহিনীর সদস্যরা আঁচ করতে পেরে মধ্য রাতে শেরপুরের পুরো গ্রামজুড়ে আগুন জ্বালিয়ে বেপরোয়াভাবে গুলি বর্ষণ করেন। তবে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর অবস্থান জানতে পেরে দৌলতপুর ও মিরপুরের মধ্যবর্তী স্থান সাগরখালী নদীর তীরে তাদের অবস্থান খুব দ্রুতই আরো সুদৃঢ় করেন। রাত ৩টায় তারা পাক হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে থাকেন।

২৬ নভেম্বর ভোর ৫টায় উভয়পক্ষ পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে টানা ৬ ঘণ্টাব্যাপী তুমুল যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই গেরিলা যুদ্ধে অন্তত ৬০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং শেরপুর গ্রামের মৃত হাজি মেহের আলীর ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান শহীদ হন।

দৌলতপুর উপজেলার গ্রোয়ালগ্রাম বধ্যভূমিতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ -ফাইল ছবি।

এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে এ উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের গোয়ালগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় নিরীহ মানুষের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় পাকবাহিনী। এতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্তত ১৭ জন শহীদ হন। তাদের মধ্যে কয়েকজন নারীও ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এখানকার গৌরবময় ইতিহাসের এক নির্মম সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই গোয়ালগ্রাম বধ্যভূমি। এটি ছিল দৌলতপুর উপজেলায় পাক হানাদার বাহিনীর সবচেয়ে বড় অপারেশন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকারে আসার পর এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে গোয়ালগ্রাম বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।

অন্যদিকে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে সর্বশেষ শহীদ হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলমের নামানুসারে তার নিজ গ্রাম উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের ফারাকপুর এলাকাকে ‘রফিকনগর’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। একই সঙ্গে ৮ ডিসেম্বরকে ‘শহীদ রফিক দিবস’ হিসেবেও পালন করেন স্থানীয়রা। প্রতিবছর তাঁর সমাধিতে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডসহ বিভিন্ন সংগঠন।

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ৮ নম্বর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নুরুন্নবীর নেতৃত্বে দৌলতপুরকে শত্রুমুক্ত করে দৌলতপুর থানা চত্ত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিকামী বীর সন্তানেরা। এ দিন পাক হানাদার মুক্ত হওয়ার খবর এখানকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন বয়সের হাজারো নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে এসে বিজয় উল্লাস করেন।

দৌলতপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, উপজেলা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম কমান্ডসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে বুধবার (৮ ডিসেম্বর) র‌্যালি ও আলোচনা অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। অপরদিকে একাত্তরের আজকের এই দিনেই পার্শ্ববর্তী ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলাও হানাদার মুক্ত হয়।

ডিসেম্বর ০৮.২০২১ at ২১:৫৬:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এআস/জআ