নিরাপদ পানির সমস্যায় জর্জরিত তালা উপজেলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শত শত মানুষ নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং হাইজিন সংকটে ভুগছে। নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি ডায়রিয়া, আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, চুলকানি, পাচড়া, উচ্চ রক্তচাপ, হাপানীসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব এলাকায় অধিকাংশ মানুষ অগভীর নলক‚পের পানি ব্যবহার করেন। নলকুপগুলোর অধিকাংশই আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত। নলকুপের গোড়া ময়লা আবর্জনায় ভরা। অধিকাংশ নলকুপের গোড়া এখনো পাকা নয়। উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ এখনো ব্যবহার করছেন আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি। এছাড়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শত শত পরিবার ব্যবহার করে না স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা।

একসময় তারা খোলা আকাশের নিচে বনে-বাদাড়ে ঝোঁপের আড়ালে মলত্যাগ করতো। এখন সে অবস্থা না থাকলেও যে পায়খানা ব্যবহার করেন তা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ৪/৫টি রিং  বসিয়ে তা বস্তা কিংবা কাপড় দিয়ে ঘিরে সেখানেই মলত্যাগ করেন প্রতিবন্ধী, বয়স্ক নারী, পুরুষ ও শিশুরা। একটি পায়খানা ব্যবহার করেন ৩/৪টি পরিবার । পায়খানা ব্যবহারের পরে সাবান কিংবা ছাঁই দিয়ে হাত পরিস্কার করা নাকি তাদের কাছে বিলাসিতা। পরিস্কার পরিচ্ছতা সম্পর্কে এখনো অনেকেই সচেতন নয়।

আরো পড়ুন:
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা ঘটনায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনের যাবজ্জীবন
অভয়নগরে মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন যাঁরা

বে-সরকারী সংস্থা উত্তরণ এর তথ্যানুসারে জানা গেছে, উপজেলার খলিষখালী, জালালপুর এবং নগরঘাটা এই ৩ ইউনিয়নের ৬৬ গ্রামের মোট ১৫ হাজার ৮০০ পরিবার এখনো নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং হাইজিন সমস্যায় আক্রান্ত। আর এই সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এলাকাবাসীকে সচেতন করার জন্য সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বে-সরকারী সংস্থা উত্তরণ। উত্তরণের নিউ এরিয়া ওয়াশ এসডিজি ওয়াই এসপি বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় তালা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে উক্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া একই প্রকল্পের আওতায় তিন ইউনিয়নের ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ক্যাম্পেইন, শিক্ষকদের সাথে ম্যানেজিং কমিটির মিটিং এবং ওয়াশ তথা পানি, পায়খানা, হাতধোয়া ও পরিস্কার পরিচ্ছনানতার পাশাপাশি ছাত্রীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ন্যাপকিন কর্ণার তৈরি করেছেন তারা।
জালালপুর ইউনিয়নের কানাইদিয়া গ্রামের অর্চনা দেবনাথ, আটুলিয়ার শাপলা খাতুন, খলিষখালী ইউনিয়নের বয়ারডাঙ্গা গ্রামের তাসলিমা বেগম, ফাহিমা বেগম, বাগডাঙ্গা গ্রামের খুকুমনি মন্ডল, নগরঘাটার বাখখালীর শিউলি মুন্ডা, ভৈরবনগরের অরুনা সন্ডলসহ অনেকেই বিশুদ্ধ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও হাইজিন সমস্যার কথা তুলে ধরে এপ্রতিনিধিকে বলেন, তাদের এলাকায় বৃষ্টির সময় ৫/৬ মাস জলাবদ্ধতা থাকে এবং লবণাক্ত থাকায় খাবার পানির কোন ব্যবস্থা নেই। প্রায় ২/৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এক কলস খাবার পানি আনতে হয়। আবার এক ড্রাম পানি ২৫ থেকে ৩০ টাকা দিয়ে কিনে খাওয়া লাগে।তারা আরও বলেন, বর্ষা মৌসমে জলাবদ্ধতা এবং এলাকায় শত শত মাছের ঘেরের কারণে পানি সঠিকপথে নিষ্কাশন হতে পারে না। এ সময় তাদের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। উত্তরণ অত্র এলাকা সমুহে নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কাজ চলছে। ভুক্তভোগিরা নিরাপদ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য উত্তরণের কাজ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উত্তরণের ওয়াশ (নিউ এরিয়া ওয়াশ এসডিজি ওয়াই এসপি বাংলাদেশ) এর পিও মোঃ সোহেল রানা এপ্রতিনিধিকে জানান, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অত্র তিনটি ইউনিয়নে ২০২১ সালের জানুয়ারী মাস থেকে কাজ করে চলছে উত্তরণ। উপজেলার খলিষখালী ইউনিয়নের ৩২ গ্রামের ৬২০০ পরিবার, জালালপুরের ১৩টি গ্রামের ৫৪০০ পরিবার, নগরঘাটা ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের ৪২০০ পরিবার এবং ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত উক্ত কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে চলবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জালালপুর ইউপি চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু এপ্রতিনিধিকে জানান, এলাকায় খাবার পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিনের পাশাপাশি আর্সেনিকের সমস্যা প্রকট। ভয়াবহ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে অত্র এলাকার কৃষ্ণকাটী গ্রামের একই পরিবারের ৪ জনেরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, খাবার পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করতে সরকারি বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী। উত্তরণ দীর্ঘদিন ধরে অত্র এলাকায় হতদরিদ্র ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি বিভিন্ন এ্যাডভোকেসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সরকারের পাশাপাশি উত্তরণসহ বিভিন্ন বে-সরকারি সংস্থার কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
তালা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ মফিজুর রহমান এপ্রতিনিধিকে জানান, উপজেলার কয়েকটি এলাকায় লেয়ার না পাওয়ায় ডিপটিউবওয়েল বসানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। বিশেষ করে জালালপুর ও খলিষখালী ইউনিয়নে এই সমস্য বেশি। কিন্তু ২০০ ফুটের মধ্যে কিছু টিউবওয়েল বসলেও তাতে প্রায় ৯৫ ভাগ আর্সেনিক ও আয়রণের সমস্যা থেকে যাচ্ছে। তবে নগরঘাটা এলাকার অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল। তিনি আরও বলেন, নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আগের চেয়ে বর্তমানে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। খোলা স্থানে মলত্যাগের হারও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

ডিসেম্বর ০৮.২০২১ at ১৪:০৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/রট/এমএইচ