সড়কে শৃঙ্খলা আনার চ্যালেঞ্জ

সংশোধিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস হতে পারে জানুয়ারি মাসে। নিয়ন্ত্রণহীন সড়ক। চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলছে দেশের পরিবহন খাত। আইন-কানুন মানার বালাই নেই। চালক-হেলপাররা বেপরোয়া। সংঘবদ্ধ মালিক শ্রমিকদের কাছে যাত্রীরা জিম্মি। এমনকি তাদের চাপের কাছে বারবার নতি স্বীকার করতে হচ্ছে সরকারকেও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সড়কের নৈরাজ্য দেখেও দেখে না। অনিয়ম-অদক্ষতার আখড়া পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিআরটিএ।

পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা সরকারের মন্ত্রী-নেতা। অভিযোগ রয়েছে, এই সুবাদে ক্ষমতার প্রশ্রয়েই সড়কে চলছে অরাজকতা। এমন অবস্থায় সবার এখন একটাই প্রশ্ন- সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে। কিন্তু কারো কাছেই এর জবাব নেই। গণপরিবহনের চালকদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের চালকরাও এখন সড়কে বেপরোয়া। সিটি করপোরেশনের গাড়ির চাপায় হতাহতের ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই।

পুরো বিষয়টি এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে সড়ক আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি আবারো সামনে চলে এসেছে। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ শুধু কাগজেই সীমাবন্ধ থাকবে নাকি আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হবে- জানতে চান সবাই।

এদিকে সংশোধিত নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি এখনো জাতীয় সংসদে পাস হয়নি। তবে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে সংশোধিত আইনটি পাস হওয়ার পর পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবি, এরপর শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার দাবি এবং এখন প্রতিদিনই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে দেশের সড়ক পরিস্থিতি এখন বেশ উত্তপ্ত। গত দুই সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের ফলে রাজধানীতে অনেকটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এতে সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় ভোগান্তিতে।

এজন্য অনেকেই পরিবহন সেক্টরের নেতাদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব এবং চালক-হেলপারদের বেপরোয়া আচরণকেই দায়ী করেন। তাদের কারণেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না, অভিমত সংশ্লিষ্টদের। ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বলেন, তেলের দাম বাড়ার পর দফায় দফায় পরিবহন ধর্মঘট না ডেকেই তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে ভাড়া বাড়ানোর দাবি আদায় করতে পারত।

কিন্তু তারা তা করেনি। পরবর্তী সময়ে ভাড়া বাড়ানোর পর নিজেদের উচ্ছেমতো ভাড়া নেয়া এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া না নেয়া, দুর্ব্যবহার করা, শিক্ষার্থীসহ যাত্রীদের বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়ার মতো বেপরোয়া আচরণের কারণেই শিক্ষার্থীরা এখনো ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সড়কে আন্দোলন করছে।

উপরন্তু দীর্ঘদিনেও সড়ক পরিবহন আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। রাজধানীর সড়কে এখন কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যেভাবে পারছে নিজেদের ইচ্ছেমতো চলাচল করছে। বাসগুলো রাস্তার মাঝখানে থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে, কেউ তাদের কিছুই বলছে না। শৃঙ্খলা না থাকায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, আমাদের দেশে সব সেক্টরেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে সরকারের একার পক্ষে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সবাইকে আন্তরিকতা নিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। সবকিছুর জন্য সরকার, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আগে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সহযোগিতা থাকলে সড়ক নিরাপদ হবে, শৃঙ্খলা ফিরবে।

‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দেশজুড়ে অনেক আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে। কিন্তু আইনটি এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া দুঃখজনক। শুনেছি আইন সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত আইনটিও এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। দ্রুত আইনটি সংসদে পাস করে পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য আমি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। তা না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না।

আরো পড়ুন :
কালকিনিতে বালুবাহী ট্রলি চাপায় মালিক নিহত
স্কুলে ভর্তির শেষ তারিখ ৩০ ডিসেম্বর

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সরকারের কাছে ১১১টি সুপারিশ জমা দিয়েছিল। এই কমিটির সদস্য বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহজাহান খান এমপি বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইনের ৪৩টি ধারা সংশোধনের জন্য আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি। এর মধ্যে ৩৪টি ধারার সংশোধন হয়েছে। আগামী সংসদে আইনটি পাস হবে বলে শুনেছি। আমরা আইন মানার জন্য চালক ও তাদের সহকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছি।

তবে ১১১ সুপারিশের মধ্যে চালকদের জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিং সেন্টারের ব্যবস্থা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সচেতনতার বিষয়টিও আছে। কিন্তু সড়কে চলাচলের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। আইন পাসের পর পুরোপুরি কার্যকর করা হলেও সড়ক নিরাপদ করতে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় সুফল পেতে সময় লাগবে বলে আমি মনে করি।

জানা গেছে, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ সংশোধন করা হচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সংশোধনীর ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত এবং বিআরটিএর যাচাই-বাছাইয়ের পর খসড়া সংশোধনী চূড়ান্ত করেছে। চলতি অধিবেশনে আইনটি পাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে এই অধিবেশনে পাস হয়নি। তবে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের সংসদ অধিবেশনে আইনটি পাস হবে বলে সম্প্রতি সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন। তিনি এও জানিয়েছেন, কিছু ধারার সংশোধন করা হলেও যেসব ধারায় কঠোরতা রয়েছে সেগুলো নমনীয় করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আইন সংশোধনের জন্য আমরা সরকারের কাছে কোনো চাপ প্রয়োগ করিনি। আইনের ৩৪টি ধারা সংশোধনের দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরেছিলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি আমাদের যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলো সংশোধন করেছে। এজন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আইনটি দ্রুত পাস হলে জনগণ এবং সড়ক পরিবহন সেক্টরের সবাই উপকৃত হবে। সড়কে শঙ্খলা ফিরবে।

ডিসেম্বর ০৩.২০২১ at ০৯:৩৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভোকা/রারি