ভেড়া পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন গাইবান্ধার চরাঞ্চলের নারীরা

ব্রহ্মপুত্র নদসহ তিস্তা ও যমুনা নদীবেষ্টিত গাইবান্ধার চরাঞ্চলগুলোতে ভেড়া পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন হতদরিদ্র নারীরা। এতে আরও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের ভেড়া পালন। শুধু তাই নয়, উঠানে সবজি চাষ করে সংসারে স্বচ্ছলতার মুখ দেখছেন তারা। ফ্রেন্ডশিপের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক প্রকল্প (এএসডি) এতে সহযোগিতা করছে। আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে দাতাসংস্থা ফ্রেন্ডশিপ লুক্সেমবার্গ।

গাইবান্ধা প্রাণিসম্পদ বিভাগ, প্রাণিসম্পদ গবেষক ও এএসডি প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধার সাত উপজেলায় ভেড়া আছে ৬৯ হাজার ৫৫২টি ও চর আছে ৮০টি। এসব চরাঞ্চলে ভেড়া আছে তিন সহস্রাধিক। ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগের কারিগরী সহযোগিতায় দেশী ভেড়াকে ভারতের মোজাফফর নগর জাতের বীজ (শুক্রানু) দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করা হচ্ছে। এজন্য ভেড়ার বয়স কমপক্ষে আট মাস, সুস্থ্য ও স্বাস্থ্যবান কিনা, রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম, গরম করার হরমোন পুশ এবং সবশেষে বীজ (শুক্রানু) দেওয়া হয়।

এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চলতি বছরের জুনে গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের আনালেরছড়া, মোল্লারচর ইউনিয়নের সিধাই, ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের চর কাবিলপুর, কালাসোনা ও রতনপুর, সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া ইউনিয়নের পোড়ারচর এবং হরিপুর ইউনিয়নের চর চরিতাবাড়ী ও চর মাদারিপাড়া গ্রামের ৩৮টি ভেড়াকে কৃত্রিম প্রজনন করানো হয়েছে। এরমধ্যে গর্ভধারন করেছে ৩১টি।

আড়াই বছর পর দেশীয় জাতের ভেড়া ১৮-২৫ কেজি ওজনের হয়। যার দাম সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা মাত্র। কিন্তু এখন যেসব দেশীয় ভেড়ার সাথে ভারতের মোজাফফর নগর জাতের ভেড়ার বীজ দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করানো হচ্ছে সেগুলো আড়াই বছর পর ৪০ থেকে ৫০ কেজি ওজনের হবে। যার দাম হবে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। যা দেশীয় ভেড়ার তুলনায় অনেকগুন বেশি। ফলে উন্নত জাতের এসব ভেড়া পালন করে আর্থিকভাবে অনেকটাই স্বচ্ছল হবেন চরাঞ্চলের অনগ্রসর এলাকার এসব নারীরা।

এজন্য ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগের অন-ফার্ম টেস্টিং-পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ প্রকল্প উন্নতজাতের বীজ দিয়ে ভেড়ার কৃত্রিম প্রজননের এই কাজটি করছে। পার্টনারশীপ প্রকল্পের প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. ফরিদা ইয়াসমীন বারীর নেতৃত্বে এই দলে কাজ করছেন সাতজন। পরবর্তীতে এই কাজটি যাতে স্থানীয়ভাবেই করতে পারা যায় সেজন্য চারজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে বাকৃবি থেকে।

বাকৃবি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা চর কাবিলপুর গ্রামের শাহ দুলাল (১৮) বলেন, কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় হরমোন দিয়ে বছরে দুই বার বাচ্চা দিতে পারে ভেড়া। নয়তো প্রাকৃতিকভাবে হতে গেলে সময় বেশি লাগে। এজন্য কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় ভেড়া পালন করা বেশ লাভজনক। এছাড়া এটি স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও বেশ পুষ্টিকর ও নিরাপদ। কেননা ভেড়ায় চর্বি কম থাকায় শরীরে কোলেস্টরলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়না।

অপরদিকে প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের মধ্যে বছরে দুইবার ১৬ ধরনের শাক-সবজির বীজ দেওয়া হয়েছে। এসব বীজ থেকে ফসল ফলাতে কোন ব্যয় হয়না। কেননা এসব ফসলে জৈব সার ব্যবহার করা হয় ও প্রয়োগ করা হয়না কোন কীটনাশক। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের ফলে বিষমুক্ত শাক-সবজি বিক্রি করে কোন প্রকার খরচ ছাড়াই তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ফসল বিক্রির এই টাকায় স্বচ্ছলতা ফিরেছে পরিবারগুলোতে।

ফুলছড়ির উড়িয়া ইউনিয়নের চর কাবিলপুর গ্রামের আনজুমান বেগম (৩৩) বলেন, আগে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। গৃহস্থালীর কাজ বাদে অর্থনৈতিক কোন কাজ না করায় সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। ফ্রেন্ডশিপের দেওয়া একটি ভেড়া থেকে এখন পাঁচটি ভেড়া হয়েছে। যার দাম প্রায় ২০ হাজার টাকা। এখন আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। শুধু তাই নয়, আগে বাড়ীর উঠোন ফাঁকা পড়ে থাকতো। কোন কিছু চাষাবাদ করা হতো না। আমাকে ১৬ ধরনের শাক-সবজির যেসব বীজ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো গতবছর চার হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এবারও ওইরকম টাকায় বিক্রি করবো। শাক-সবজি বিক্রির টাকায় সপ্তম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ যুগিয়েছি। সেসব নিজেও খেয়েছি, ফলে কিনতে হয়নি। শাক-সবজি বিক্রির ওই টাকায় সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে, লাভবান হচ্ছি।

একই গ্রামের মমেনা বেগম (৪০) বলেন, আমাকে দেওয়া একটি ভেড়া থেকে এখন চারটি ভেড়া হয়েছে। তারমধ্যে আবার এখন তিনটি ভেড়া গর্ভবর্তী। খুব তাড়াতাড়ি এগুলো বাচ্চা দেবে। তখন আট থেকে দশটি ভেড়া হবে। এটা আমার একটা স্থায়ী সম্পদ হলো। কেননা ভেড়ার তেমন একটা রোগবালাই নাই, পুষ্টি বেশ থাকায় চাহিদাও বেশি, আর মৃত্যুহারও নেই বললেই চলে। এছাড়া গতবছর শাক-সবজি বিক্রি করে তিন হাজা টাকা পেয়েছি। এবার দুই হাজার টাকার মতো বিক্রি করেছি। আর দুই হাজার টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো শাক-সবজি। এই টাকায় এক ছেলে এক মেয়ের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছি। ফলে লাভবান হয়েছি এতোদিন পড়ে থাকা বাড়ির আঙিনায় ফাঁকা জায়গায় শাক-সবজির চাষ করে।

এই গ্রামের শাহনাজ বেগম (৩৫) বলেন, স্বামী দিনমজুরি ও কৃষি কাজ করেন। বছরে তিন-চার মাস কাজ থাকলেও বাকী সময়টা তেমন কাজ থাকেনা। ফলে সংসারে স্বচ্ছলতা ছিলনা। এখন ভেড়া পালনের পাশাপাশি বাড়ীর উঠানের ফাঁকা জায়গায় শাক-সবজির চাষ করে বাড়তি আয়ের মুখ দেখছি। সেই টাকায় সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে।

আরো পড়ুন:
বারেক টিলায় হাতির আগমনে আতঙ্কে সীমান্তবাসী!
প্রশাসনের কঠোর বার্তা, প্রকাশ্যে সিল মারার কথা ভুলে যান

শুধু ভেড়া ও শাক-সবজির বীজ নয়, ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রকল্প থেকে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কার্ড পাইয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রকল্প থেকে। এরমেধ্যে চর কাবিলপুর গ্রামের ৬১ বছরের বৃদ্ধ নুর আলম। ছোটবেলায় অসুখে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি আর কথা বলতে পারেন না, পাননা শুনতে। তিনি এখন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। চলতি বছরের জুনে তাকে প্রতিবন্ধি ভাতা কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন তিন মাস পরপর ২২৫০ টাকা করে পান। বয়স্ক ভাতা কার্ড করে দেওয়া হয়েছে ৬৩ বছরের মোছা. ফাতিমা ও বিধবা ভাতা কার্ড করে দেওয়া হয়েছে সাজেদা বেগমকে (৩২)। তারা তিন মাস পরপর ১৫০০ টাক করে পান। এই টাকা পেয়ে তারা বেশ উপকৃত হচ্ছেন।

এএসডির প্রকল্প ইনচার্জ দিবাকর বিশ্বাস বলেন, আরও বেশি সংখ্যক মানুষের পাশে দাঁড়াতে দুই বছর মেয়াদ শেষে প্রকল্পটি আবার অন্য চরে গিয়ে কাজ করবে। এতে করে নতুন নতুন এলাকায় আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রকল্পটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং একটি দুর্যোগ সহনশীল জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। কৃষিক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হবে।

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ভেড়া পালন করলে দ্রুত লাভবান ও স্বাবলম্বী হওয়া যাবে জানিয়ে গাইবান্ধা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মাছুদার রহমান সরকার বলেন, কৃত্রিম উপায়ে যেভাবে ভেড়াগুলোকে গরম করে কৃত্রিম প্রজনন করানো হচ্ছে। এতে করে ভেড়ার গর্ভধারনের হার অনেক বেশি পাওয়া যায়। ফলে ভেড়ার উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে। সেইসাথে আন্তঃপ্রজননে ভেড়ার উৎপাদন কমে যাবে ও জন্মাবার সময় বাচ্চা মারা যেতে পারে উল্লেখ করে সতর্ক থাকতে বলেন এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

নভেম্বর ১৮.২০২১ at ১৮:৩৯:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/সকব/জআ