দৌলতপুরে সাব-রেজিস্ট্রার হেনস্তার শিকার, পুলিশ প্রহরায় অফিস ত্যাগ

উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস। -ফাইল ছবি।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। সিন্ডিকেটের অনৈতিক চাপ ও বাধার মুখে অবশেষে পুলিশ প্রহরায় অফিস ত্যাগ করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) দিনভর জমি রেজিস্ট্রির কাজ করার পরেও আরো প্রায় অর্ধশত দলিল রেজিস্ট্রির জন্য সাব-রেজিস্ট্রারকে চাপ দেন এই অফিস কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের প্রভাবশালীরা। অফিসের সময় পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও সাব-রেজিস্ট্রারকে অফিস থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। তাকে হেনস্তা করা হয়। পরে পুলিশ প্রহরায় তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে যান। এই অফিসটিতে কিছুতেই অনিয়ম দুর্নীতি থামাতে পারছেন না কেউই। খোদ স্থানীয় সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ হস্তক্ষেপ করেও দুর্নীতির লাগাম টানতে পারেননি। এমপির হস্তক্ষেপে প্রথমের দিকে কয়েক মাস দুর্নীতির মাত্রা কমে আসলেও ফের শুরু হয় অনিয়ম দুর্নীতির মহোৎসব।

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এবারের চলমান সিন্ডিকেট গড়তে দলিল লেখকদের দুই গ্রুপ নিজেদের স্বার্থেই একত্রিত হয়ে যায়। দুই গ্রুপের দুই নেতা অঘোষিত এই সিন্ডিকেট সদস্য হন। উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নি এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা। মুন্নির নেতৃত্বে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আরজ উল্লাহ এবং ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপের কতিপয় স্থানীয় নেতার সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা দলিল প্রতি ১ হাজার ৬শ টাকা করে আদায় করে আসছেন। যা সরকার নির্ধারিত খরচের কয়েকগুণ বেশি।

এছাড়া জমি রেজিস্ট্রিতে অপরিহার্য টিপ সই নেয়ার ক্ষেত্রেও একেকজনের কাছ ১৫০ টাকা করে আদায় করা হয়। বিপুল অঙ্কের এই টাকা জমা পড়ে প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নির কাছে। সেখান থেকে সরকারি খরচ বাদে বাকি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন তারা। স্থানীয় কতিপয় সাংবাদিকের নামেও এই টাকার একটি অংশ বরাদ্দ দেয়া হয় বলে সূত্রগুলো জানায়। তবে বেশ কয়েকজন পেশাদার সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হলে তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে জমি রেজিস্ট্রি করতে আসা সাধারণ মানুষজন সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নানামুখী হয়রানি, ভোগান্তি আর আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে আসছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়েও বাড়তি টাকা গুনতে তারা অপারগতা প্রকাশ করলেও তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সিন্ডিকেটের নির্ধারণ করা বাড়তি টাকা দিয়েই তাদের জমি রেজিস্ট্রি করতে হচ্ছে। কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ নির্বাচিত হওয়ার পর জমি রেজিস্ট্রিতে বাড়তি টাকা আদায় বা অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধে হস্তক্ষেপ করেন। এমপির ভয়ে প্রথমের দিকে দুর্নীতির মাত্রা কিছুটা কমে যায়। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই ফের শুরু হয় দুর্নীতির মহোৎসব।

সূত্র মতে, দলিল লেখক সমিতির দুই গ্রুপের মধ্যে এর আগে অাধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসলেও নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তারা অনিয়ম দুর্নীতিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। আর এখন দলিল লেখকদের দুই গ্রুপ এক হয়ে যাওয়ায় শুরু হয়েছে আরো লাগামহীন অবৈধ কর্মকাণ্ড। যা কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। ইতোপূর্বে এই সাব-রেজিস্ট্রাের অফিসের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে ভোরের কাগজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারবার খবর বের হলেও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটুও টনক নড়েনি।

প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নির নেতৃত্বে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে ইতোমধ্যে পরপর তিনজন সাব-রেজিস্ট্রার এখান থেকে স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে গেছেন। তবুও তারা এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে শামিল হননি। সবশেষ মিরপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিককে দৌলতপুরে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে সপ্তাহে দুই দিন জমি রেজিস্ট্রির কার্যক্রম চালানো হচ্ছিল। কিন্তু শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কাছে তিনিও অসহায় হয়ে পড়েন। মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হেনস্তার শিকার হন তিনি।

আরো পড়ুন :
আদিতমারী উপজেলার ৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৬ টিতে নৌকার বিজয়
মেহেরপুরে ৯ ইউনিয়নের ২ টিতে নৌকা ৭ টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয়

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিক অফিস থেকে বের হতে গেলে সিন্ডিকেটের বাধার মুখে পড়েন। তারা দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু অর্ধশত দলিল রেজিস্ট্রি করতে গেলে তার দৌলতপুরের বাইরে অবস্থিত বাসায় ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়বে, এ কারণে তিনি রাজি হননি।
এ সময় তাকে হেনস্তা করা হয়। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি দৌলতপুর থানায় ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে পুলিশ প্রহরায় অফিস ত্যাগ করেন সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিক। দৌলতপুর থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই অরুণ কুমার সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তাকে অফিস থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেন।

সিন্ডিকেটের তৎপরতার কথা স্বীকার করে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নি মোবাইল ফোনে বলেন, এখানকার পরিবেশ দিন দিন খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও বদলি হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। জমি রেজিস্ট্রিতে কয়েকগুণ বাড়তি টাকা ও সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে টিপ সইয়ে ১৫০ টাকা করে আদায় করা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আপনি অফিসে আসেন এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলবো। তার আমন্ত্রণ নাকচ করে দেয়া হলে তিনি দলিল লেখক সমিতির নেতাদের (সিন্ডিকেট সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করেন।

সিন্ডিকেটের অনৈতিক চাপ ও বাধার মুখে পুলিশের প্রহরায় অফিস ত্যাগকারী দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিকের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসির উদ্দিন বলেন, আমি নির্বাচনী ডিউটিতে আছি। সাব-রেজিস্ট্রারের নিরাপত্তাহীনতার এই বিষয়টি আমার জানা নেই।

নভেম্বর ১১.২০২১ at ২৪:০০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরসে/রারি