নওগাঁয় মাদ্রাসা’র সুপারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার কাদিয়াল সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার নওশাদ আলমের বিরদ্ধে কমিটির মেয়াদ শেষ না হতেই জালিয়াতি করে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, ভুয়া নিয়োগ সহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক দুই সদস্য জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

গত বছরের ১২ অক্টোবর ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিষয়টির তদন্তে নামেন। কিন্তু মাদ্রাসা সুপার, তাঁর অনুগত শিক্ষক ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা এই তদন্তে একাধিকবার বাধা সৃষ্টি করেন। প্রায় ৮ মাস পর চলতি বছরের জুলাই মাসে এই তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুসহাক আলী। ওই তদন্ত প্রতিবেদন মাদ্রাসার সুপারের বিরুদ্ধে যাওয়ায় ওই প্রতিবেদনে নারাজি দেন সুপার নওশাদ আলম। নারাজি আবেদনের পর বর্তমানে সুপার নওশাদ আলমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করছেন পত্নীতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটন সরকার।

মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য আব্দুল মতিন ও আইয়ুব আলীর করা লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, উপজেলার আমাইড় ইউনিয়নের কাদিয়াল সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই মাদ্রাসায় নওশাদ আলম ২০১৪ সাল থেকে সুপারইনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে মাদ্রাসা শরীরচর্চা শিক্ষক আসলাম আলীর যোগসাজশে নানা অনিয়মের মাধ্যমে একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবরে গঠিত দুই বছরের জন্য নির্বাচিত ১১ সদস্যবিশিষ্ট মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। বিলে সর্বশেষ ২০২০ সালের সেপ্টম্বর মাসের বেতন-ভাতা বিলে ওই কমিটির সভাপতি আব্দুর রাকিবের প্রতিস্বাক্ষরে সর্বশেষ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছেন।

এই কমিটি বহাল থাকা অবস্থায় পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ জালিয়াতি করে একটি কমিটি গঠন করেন সুপার নওশাদ আলম। ২০১৮ সালের এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী নবসৃষ্ট কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর, ল্যাব সহকারি, আয়া ও নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে মোটা টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্য এই জালিয়াতির কমিটির গঠন করা হয়।

২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাশেদ হোসেন এবং ১১ সেপ্টেম্বর ল্যাব সহকারী আবু সালেহ, সহকারী গ্রন্থাগারিক রাবেয়া খাতুন ও আয়া পদে সুলতানা বেগমকে যোগদান দেখিয়ে এমপিওর জন্য আবেদন করা হয়েছে। জালিয়তির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে ১১/১০/২০২০ ইং মাসে ঐ জালিয়াতি কমিটির সভাপতি আবুল হেসেনের সাক্ষরিত বেতন ভাতার একটি বিল পত্নীতলা সোনালী ব্যাংক শাখায় জমা প্রদান করে বিল উত্তোলন করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ২০২০ ইং সালের ১২ অক্টোবর জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য আব্দুল মতিন ও আইয়ুব আলী। ওই অভিযোগ পাওয়ার পর জালিয়াতি কমিটি বাতিল করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিস্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীরা ২০২০ সালের অক্টোবর মাসের বেতন-ভাতা উত্তোলন হয়।

জালিয়াতি কমিটির সভাপতি আবুল হোসেন ও অন্যান্য সদস্যরা বর্তমানে মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য। জালিয়াতি কমিটির মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগের বিষয়টি ধরা পড়া সত্তেও চলতি বছরের জুন মাস থেকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাশেদ হোসেন কিভাবে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এছাড়া অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া আরও চারজন শিক্ষক-কর্মচারীর নাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বিবরণীতে যুক্ত করা হয়েছে। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি গোপন করে সুপার নওশাদ আলম তাঁদের নাম এমপিওভুক্তির জন্য পাঠিয়েছেন বলে লিখিত অভিযোগে বলা হয়।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুসহাক আলী বলেন, ‘কাদিয়াল সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ করা হয়েছে তাঁর সকল সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্তের যে রকম তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি তাঁর ভিত্তিতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি এবং অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। কিন্তু মাদ্রাসা সুপার ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়েছেন। এজন্য জেলা প্রশাসক নির্দেশে ইউএনও স্যার বিষয়টি পুনরায় তদন্ত করছেন।’ অবৈধ্যভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত রাশেদ হোসেন কিভাবে এমপিওভুক্ত হলেন বলে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমার আগে যে কর্মকর্তা এখানে ছিলেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন বলে জানান। কিন্তু রাশেদ হোসেন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন ২০২০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর মাসে। আর এমপিও ভুক্ত হয় ১লা জুন ২০২১ সালে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপার নওশাদ আলম দাবি করেন, ‘আমার সময়ে শুধু একটি নিয়োগ হয়েছে। সেটি হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাশেদ হোসেনের এবং তিনি বর্তমানে এমপিওভুক্ত কর্মচারী। এই প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী হিসেবে অন্য তিন-চারজনের নাম কিভাবে ব্যানবেইসে যুক্ত হয়েছে তা আমার জানা নেই। অবৈধ কমিটি গঠনের যে অভিযোগ করা হয়েছে সেটিও সঠিক নয়। মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক দুই সদস্য যে সমস্ত অভিযোগ করেছেন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তার কোনো ভিত্তি নেই। বর্তমান তদন্ত কমিটির কাছে আমার স্বপক্ষে সকল কাগজপত্র হাজির করব এবং নির্দোষ প্রমাণিত হব।

আরো পড়ুন:
রাজধানীর গ্রিন রোডে গৃহকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যু, বাড়ি ঘেরাও
বিজিবিতে ‘সিপাহী (জিডি)’ পদে চাকরির সুযোগ

সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আব্দুর রকিব বলেন, ওই মাদ্রাসার সুপার যে পাঁচজনকে নিয়োগ দেখিয়েছেন তা আমি জনিনা । এবং সেই সময় আমরা কোন নিয়োগ দেই নাই। তিনি আরো বলেন, ঐসব নিয়োগ সংক্রান্ত কোন রেজুলেশানও নেই। তিনিই জালিয়াতির মাধ্যমেই এসব করেছেন।

পত্নীতলার ইউএনও লিটন সরকার বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে দুই পক্ষকে একাধিকবার শুনানিতে ডাকা হয়েছে। উভয় পক্ষের সাক্ষ্য ও যুক্তি শুনেছি। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে মাদ্রাসা সুপার তাঁর যুক্তির স্বপক্ষে আরও কিছু নথিপত্র হাজির করার জন্য সময় চেয়েছেন। আগামী দু-চার দিনের মধ্যে কাগজ পত্র জমা দেওয়ার কথা। আশা করছি, খুব কম সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।

অক্টোবর  ১৩.২০২১ at ১২:১৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/সরস/জআ