কনস্টেবল বন্ধুকে নিয়ে এসপির আবেগঘন স্ট্যাটাস

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ ও কনস্টেবল সিদ্দিক

বন্ধু এমন একটা শব্দ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক আবেগ, ভালোবাসা, আস্থা আর ভরসা। আসলে বন্ধু নামক সম্পর্ককে কোনো সংজ্ঞায়ই সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়, বন্ধু বন্ধুই। বন্ধু তো সেই, যার সঙ্গে আপনার ভেতরকার চাপানো শেষ কথাটুকুও ভাগাভাগি করা যায়। বন্ধু মানে অন্ধকার পথে হঠাৎ আলোর ঝলকানি, বন্ধু মানে একটাই প্রতিজ্ঞা পাশেই আছি। সাধারণত আমরা সবাইকে বন্ধু বলে থাকি, কিন্তু সবাই প্রকৃত বন্ধু নয়। প্রকৃত বন্ধু সে, যে বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থাকে।

পুলিশ প্রশাসনের পদবীর প্রটোকল আটকাতে পারেনি কনস্টেবল আর এক পুলিশ সুপারের (এসপি) বন্ধুত্বকে। ঘটনাটি সত্যিকারের বন্ধুত্বের উদাহরণ হয়ে থাকবে। সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

আমাদের সমাজে সচরাচর দেখা যায়- ক্যারিয়ারের দিক থেকে, কিংবা অর্থবিত্তের দিক থেকে বন্ধুদের কেউ উপরে উঠে গেলে তার পেছনে পড়া বন্ধুদের অবহেলা করেন, অবজ্ঞা করেন কিংবা ছোট করে দেখেন। যেখান থেকেই শুরু হয় বন্ধুত্বের দূরত্ব। এক্ষেত্রে এক ভিন্ন রকমের উদাহরণ স্থাপন করলেন সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে কর্মরত বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ।

এই কর্মকর্তা তার স্কুল জীবনের বন্ধু কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিকের বিপদে কেবল আশ্বাস দিয়ে নয়, বাস্তবিকভাবেই পাশে দাঁড়িয়েছেন। যে কারণে ওই বন্ধুর পরিবারেও প্রশান্তি নেমে আসে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ নিজের ফেসবুক আইডিতে ঘটনাটি জানিয়ে ‘বন্ধুর জন্য ভালবাসা’ শিরোনামে একটি পোস্ট করেছেন। তার পোস্টটি নিচে তুলে ধরা হলো-

বন্ধুর জন্য ভালবাসা
‘বিসিএসের রেজাল্ট যেদিন বের হয় সেদিন কিভাবে জানি সে খবর পেয়ে যায়। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে খুশিতে তার উল্লাস-উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। মনে হচ্ছিল যেন সে-ই চাকরি পেয়েছে। বলতেছিল তুমি পুলিশে এএসপি হয়েছো, একসময় এসপি হবে, ডিআইজি হবে। কি যে ভালো লাগছে আমার তোমাকে বুঝাতে পারব না, মনে হচ্ছে যেন আমিই এএসপি হয়েছি। সে বলতেছিল আমাদের এলাকায় শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি অফিসার অনেক রয়েছে, কিন্তু বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা একেবারেই নেই, তুমি আমাদের এই অভাবটা পূরণ করলে। কথাগুলো সে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল।

সিদ্দিক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে নিউমার্কেট থানার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমরা ছেলেবেলার বন্ধু, প্রাইমারি আর হাইস্কুল একইসাথে পড়েছি। সুদর্শন সুঠাম চেহারার সিদ্দিক এসএসসি পাস করার পর পুলিশে যোগ দেয়। একজন টগবগে যুবক দ্রুত চাকরি পেয়ে এলাকায় পুলিশ সিদ্দিক হিসেবে পরিচিতি পায়। সবাই তাকে চেনে, মানুষের প্রয়োজনে সাধ্যমতো কমবেশি সে পাশে দাঁড়ায়। ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা ভার্সিটি পড়াকালীন সময়েও আমার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে সে। ১৫ বছর পুলিশি চাকরিকালে তার সাথে অনেক দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তার এলাকার সমস্যায় আমাকে ইনভলভ করেছে। তার সাথে আমার সম্পর্ক সেই ছেলেবেলার মতোই। আমার বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধব যারা সাব-ইন্সপেক্টর/সার্জেন্ট থেকে ইন্সপেক্টর হয়েছে, আবার অনেক বন্ধু বিসিএসের জুনিয়র তাদের সাথে সাক্ষাৎ কিংবা কথা হলে আমি সহজ করে দিলেও তাদের ভেতর একটা অস্বস্তি কাজ করে যে তারা আমায় আপনি বলবে, না স্যার বলবে না তুই বলবে দ্বিধায় থাকে!

কিন্তু কনস্টেবল বন্ধুটির মাঝে বিন্দু পরিমাণ ভাবনা আসতে দিতাম না, যাতে সে কখনোই মনে না করে তার সামনে আমি একজন বড় কর্মকর্তা। সে যেন সবসময় ধারণা রাখে আমি তার ছেলেবেলারই বন্ধু। অতি সম্প্রতি সে ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে সিলেট বিভাগে বদলির আদেশ পায়। সে তার পরিবার সন্তান-সন্ততি নিয়ে ময়মনসিংহে বসবাস করে। জামালপুর গ্রামের বাড়ি মা-বাবা ভাই-বোনসহ অনেকের প্রয়োজন মুহূর্তেই সে পাশে দাঁড়ায়। সিলেট বিভাগে বদলির খবরে দারুণ অসহায় বোধ করে এবং ভেঙে পড়ে সে। চারদিকে জোর চেষ্টা-তদবির দৌঁড়িয়েও বদলি বাতিলে ব্যর্থ হয় সে। তার সমস্যার কথাটা অবশেষে আমায় জানায়। পুলিশের জুনিয়র সদস্যদের জেলার ভেতরে বদলির জন্য সহজে চেষ্টা করা যায় কিংবা বিভাগের মধ্যেও ডিআইজি স্যারকে বলা যায়। কিন্তু এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে বদলি আইজিপি স্যারের অফিস তথা পুলিশ সদর দপ্তর করে থাকে, সেজন্য এ কাজটা সবসময়ই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। নিয়তি আর ভাগ্য বলে মেনে নেয় অনেকেই। সিদ্দিক অনেক জায়গায় যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়।

আরো পড়ুন:
হ্যাটট্রিক জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ
হজ-ওমরাহ পালনে জটিলতা নিরসনে সৌদি গেলেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল

আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে যোগাযোগ করি। সাত দিনের ভেতরেই সিদ্দিকের কাজটা হয়ে যায়। আমি আগেও এরকম কাজে চেষ্টা করেছি অনেককে বদলি করিয়েছি, কিন্তু এটা এত দ্রুত সাত দিনের ভেতরে হয়ে যাওয়ায় আমি তাজ্জব বনে আশ্চর্য হই আবার লজ্জাও বোধ করি, ফোন না করে শুধুমাত্র টেক্সটে থ্যাংকস জানাই।

পুলিশ সদর দপ্তরের কনসার্নড ডেস্ক অফিসার এআইজি মাহবুব ভাই চব্বিশ বিসিএসে আমার ব্যাচমেট। সশরীরে তার সাথে সাক্ষাতে কৃতজ্ঞতায় বলি, ম্যাজিকের মতো কাজটা কিভাবে এত দ্রুত করে দিলেন? মাহবুব ভাইয়ের উত্তরটা ছিল মাত্র দুলাইনের, একজন কনস্টেবলের আপনত্ব বোধে যেভাবে হাইলাইটস করে আপনি বলেছেন, সে আপনার প্রাইমারি এবং হাইস্কুলের বন্ধু, একই এলাকার আপনারা। বদলিতে তার পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপদে পড়ছে, ভাই আপনি একটু দেখবেন, প্লিজ! আমার কাছে আপনার আকুতিটা এত ভালো লেগেছে যে, আপনি একজন সামান্য কনস্টেবলকে সম্মান দিয়ে নিজের ভাই-বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন! অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দিয়ে তাই আপনার বন্ধুর কাজটাই আমার কাছে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো।’

সেপ্টেম্বর ১৪.২০২১ at ১২:১০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/জানি/জআ