মোবাইল ফোন ব্যবহারে ভোগান্তি বাড়ছেই

মোবাইল টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবায় গ্রাহকদের ভোগান্তি কমছে না। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। গত দুই বছরে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা প্রায় ৪২ হাজার অভিযোগ জমা দিয়েছেন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি)। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৯৫টিই ভয়েস কল ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা নিয়ে। অসহনীয় মাত্রায় কল কেটে যাওয়া (ড্রপ), ইন্টারনেটে ধীরগতি, বিভিন্ন প্যাকেজের ফাঁদ, গ্রাহকের অজান্তে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস চালু করে টাকা কেটে নেওয়া- এরকম অভিযোগই বেশি।

শুধু বিটিআরসিতে জমা পড়া অভিযোগ নয়, গ্রাহকদের সঙ্গে আলাপ করে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, মোবাইল ফোনে কথা বলে শান্তি নেই। বারবার কেটে যায়। ইন্টারনেটও সাশ্রয়ী নয়। ব্যবহারেও নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়। তবু বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

যাচাই করে দেখা যায়, ঢাকা থেকে বের হয়ে গাজীপুর পার হওয়ার পর ইন্টারনেটের গতি কমতে থাকে। সাভার এবং নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজ পার হওয়ার পরও একই অবস্থা। হাইওয়েতে অধিকাংশ স্থানে ফোরজি পাওয়া যায় না। মাওয়া ঘাটের পর ফরিদপুর থেকে খুলনা যাওয়ার পথে অধিকাংশ স্থানেই ফোরজি নেই। নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ঢাকা-খুলনা এবং ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটে চারটি অপারেটরের সিমকার্ড নিয়ে ভ্রমণ করতে দেখা গেছে অনেককে।

ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, রাজধানীর ভেতরেও অনেক স্থানে ফোরজি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এমনকি অনেক স্থানে কিছু অপারেটরের ফোন নেটওয়ার্কও পাওয়া যায় না।

গ্রাহকদের আরও অভিযোগ, মোবাইল অপারেটরদের ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাটা প্যাকেজ নিতে গিয়ে তারা প্রতারিত হচ্ছেন। কম টাকায় বেশি ডাটার অপারেটরের লোভনীয় অফারের মেসেজ দেখে অনেকেই প্যাকেজ কিনে দেখছেন, সুনির্দিষ্ট একটি অ্যাপ ছাড়া আর কিছুতেই এ প্যাকেজের ডাটা ব্যবহার করা যায় না।

বাংলাদেশি মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্যও অনেক বেশি। সমকালের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্য অনেক বেশি। ভারতে মোবাইল অপারটেররা প্যাকেজে গ্রাহকদের যে সুবিধা দেয়, বাংলাদেশি অপারেটররা তা দেয় না।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবায় এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এখন এসব অভিযোগের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহকসেবায় গুণগত মান নিশ্চিত করতে এবং ইন্টারনেট প্যাকেজ নিয়ে গ্রাহক অভিযোগ নিরসনে বিটিআরসি একটি কমিটি করেছে। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দাবি এক, চিত্র আর এক :গত ১৯ আগস্ট মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মোবাইল অপারেটরদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, অপারেটররা গ্রাহকদের মানসম্মত ভয়েস কল ও ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এ কারণে দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ও কল ড্রপ বিটিআরসি নির্ধারিত মানদণ্ডের মধ্যেই আছে। তারা যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বে মোবাইল ইন্টারনেটের দামের দিক থেকে সবচেয়ে কম দাম নেওয়া দেশের তালিকায় থাকা ২০টি দেশের মধ্যে একটি বাংলাদেশ।

এর তিন দিন পর ২২ আগস্ট বিটিআরসির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে গ্রাহকরা মোবাইল অপারেটরদের সেবার মান নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশ নেওয়া গ্রাহকদের বেশির ভাগই অতি মাত্রায় কল ড্রপ, ইন্টারনেটে ধীরগতি এবং ফোরজি না পাওয়ার কথা জানান। গ্রাহকের অজান্তে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস চালু করে টাকা কেটে নেওয়ারও অভিযোগ করেন। গণশুনানিতেই গ্রাহকদের প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসি জানায়, গত দুই বছরে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে প্রায় ৪২ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে।

কম দামের দাবিও যথার্থ নয় :অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার যে দাবি অপারেটররা করে, তার যথার্থতা নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারতে রিয়ালায়েন্স জিও, ভারতি এয়ারটেলের মতো অপারেটরদের প্যাকেজ বাংলাদেশের অপারেটরদের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী। যেমন- ভারতি এয়ারটেল ২৮ দিন মেয়াদে ২৪৯ রুপিতে যে প্যাকেজ দিচ্ছে, সেখানে ভয়েস কল আনলিমিটেড। পাশাপাশি মেয়াদের প্রতিদিন গ্রাহক এক গিগাবাইট (জিবি) পরিমাণ ডাটা ব্যবহার করতে পারবেন এবং ১০০টি এসএমএস পাঠাতে পারবেন। অর্থাৎ, গ্রাহক ২৯৯ রুপি দিয়ে ২৮ জিবি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। ভারতীয় রুপি ও বাংলাদেশি টাকার বিনিময় মূল্য বর্তমানে ১ টাকা ১৬ পয়সা থেকে ১ টাকা ২০ পয়সা ওঠা-নামা করে। ১ টাকা ২০ পয়সা বিনিময় মূল্য ধরলে ভারতীয় ২৯৯ রুপির বিপরীতে হয় ৩৫৯ টাকা। এখন ৩৫৯ টাকায় ২৮ জিবি ইন্টারনেট পাওয়া গেলে প্রতি জিবি ইন্টারনেটের দাম পড়ে ১২ টাকা ৮১ পয়সা।

রিলায়েন্স জিও একই ধরনের প্যাকেজ দেয়। এতে ৪৯৯ রুপিতে ৩০ দিন মেয়াদে প্রতিদিন ৩ জিবি ডাটা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ গ্রাহক ৪৯৯ রুপিতে ৯০ জিবি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। এখানে বাংলাদেশি টাকায় প্রতি জিবি ইন্টারনেটের দাম পড়ে ৬ টাকা ৬৫ পয়সা। এর পাশাপাশি ৫৬ দিন মেয়াদ, ৮৪ দিন মেয়াদে ৫৪৯ রুপি থেকে ৬৪৯ রুপির নির্দিষ্ট ডাটার প্যাকেজ আছে, যার পরিমাণ ৬০ জিবি থেকে ৭৫ জিবি। এখানে ৬০ জিবির দাম ৬৪৯ রুপি বা ৭৭৮ টাকা হলে প্রতি জিবির দাম হয় ১২ টাকা ৯৮ পয়সা।

অন্যদিকে বাংলাদেশে চারটি মোবাইল অপারেটরের প্যাকেজেই বিশেষ অফার ছাড়া ৩০ দিন মেয়াদে ১ জিবি ইন্টারনেটের সর্বনিম্ন দাম পড়ে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। যেমমন- গ্রামীণফোনের নিয়মিত ইন্টারনেট প্যাকেজ তালিকায় ৩০ দিন মেয়াদে ২৯৯ টাকায় ৫ জিবির প্যাকেজ রয়েছে। এতে প্রতি জিবি ইন্টারনেটের দাম পড়ে ৫৯ টাকা ৮০ পয়সা। আবার ফ্ল্যাক্সি প্ল্যানে ৩০ দিন মেয়াদে ১ জিবি ইন্টারনেট কেনার সুযোগ নেই। এখানে ৩০ দিন মেয়াদে ১ দশমিক ৫ জিবি ইন্টারনেট কিনলে খরচ পড়ে ১৪৭ টাকা ৬৯ পয়সা। এ হিসাবে এক জিবি ইন্টারনেটের দাম পড়ে ৯৮ টাকা ৪৬ পয়সা।

৩০ দিন মেয়াদে বড় আকারের প্যাকেজেও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অপারেটরদের দাম বেশি। যেমন ৪০ জিবির জন্য গ্রামীণফোনের ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য ৬৪৯ টাকা। এখানে প্রতি জিবি ইন্টারনেটের দাম পড়ে ১৬ টাকা ২২ পয়সা। বাংলালিংকের ৩০ দিন মেয়াদে ৫৫ জিবি ইন্টারনেটের দাম ৯৯৯ টাকা। এই হিসাবে প্রতি জিবি ইন্টারনেটের দাম পড়ছে ১৮ টাকা ১৬ পয়সা। রবির ২৮ দিন মেয়াদে ২৫ জিবির দাম ৬৪৯ টাকা। প্রতি জিবির দাম পড়ে ২৫ টাকা ৯৬ পয়সা। রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটকের প্যাকেজ তালিকা অনুযায়ী নিয়মিত প্যাকের ক্ষেত্রে ৩০ দিন মেয়াদে এক জিবি ইন্টারনেটের দাম ৪৯ টাকা।

বাংলাদেশে অপারেটররা গ্রাহকদের কিছু বিশেষ অফার দেয়, যেখানে ইন্টারনেটের মূল্য কম পড়ে। কিন্তু এগুলোতে অব্যবহূত ডাটা গ্রাহককে ফেরত দেওয়া হয় না। যেমন- রবির বিশেষ অফারে ৩০ দিন মেয়াদে ৩০ জিবি ইন্টারনেট ৩৪০ টাকায় দেওয়া হয়। টেলিটকে ৩০ জিবি ইন্টারনেট ৩০ দিন মেয়াদে ৩৪৪ টাকা নেওয়া হয়। এখানে গ্রাহক ১০ জিবি ইন্টারনেট খরচ করলেন, বাকি ২০ জিবি মেয়াদ শেষে গায়েব হয়ে যায়। একই ধরনের চিত্র বাংলালিংক ও গ্রামীণফোনের বিশেষ অফারের ক্ষেত্রেও।

আবার বাংলাদেশে ইউটিউব, ইমো, ফেসবুক প্রভৃতি অ্যাপের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাটা প্যাকেজ দেওয়া হয়। যেখানে কম টাকায় বেশি ডাটা থাকলেও সেই ডাটা দিয়ে সাধারণ ব্রাউজিংয়ের সুযোগ থাকে না। ভারতের প্রায় সব ইন্টারনেট প্যাকেজে আনলিমিটেড ভয়েস কল সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না।

আরো পড়ুন :
রাজশাহীতে শিবিরের সক্রিয় সদস্য গ্রেফতার
মামলা বাজদের হাত থেকে মুক্তি পাব কী? কাহালু সংবাদ সম্মেলনে বললেন রেজাউল

বেশি দামের বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ফোন অপারেটর রবির চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মো. শাহেদুল আলম একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেন। তিনি সমকালকে বলেন, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম ‘এক অর্থে’ কম। কারণ ওখানে একজন গ্রাহককে মাসে কমপক্ষে ১৩৫ টাকা ব্যবহার করতে হয়। এটা সর্বনিম্ন খরচ। না হলে তারা সিম বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহকপ্রতি মাসিক আয় ১২০ টাকা। তাদের চেয়ে ১৫ টাকা কম।

সেপ্টেম্বর  ১১.২০২১ at ১০:৪৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/সম/রারি