অনলাইন টিভির ‘জয়জয়কার’ অবস্থা!

এস আর সেলিম

মাছরাঙা টেলিভিশনের এবারের ‘উন্মাচন’ অনুষ্ঠানের লিঙ্কটা গত রাতে এক সাংবাদিক ছোট ভাই মেসেঞ্জারে দেয়। পুরোটাই দেখলাম। কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা আর নাম সর্বস্ব অনলাইন টিভি কর্তৃপক্ষের দৌরাত্ম্য দেখে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও দারুণ মজা লাগলো। যেখানে সাংবাদিকতার নামে ঘটে যাওয়া হাস্যকর সব কাজ কারবার তুলে এনেছে ‘উন্মাচন’। অনেকটা উদ্বেগ না বলে কিছুটা উদ্বেগ বললাম আর দুঃখজনক না বলে হাস্যকর বললাম এই কারণে, সরকারি নীতিমালা যখন কার্যত অচল কিংবা ফাইলবন্দি অবস্থায় রয়ে যায়, তখন যে কোনো ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা চলতে থাকে। এতে অনিয়মের নানা ফাঁকফোকর তৈরি হয়। জবাবদিহীতার বালাই থাকে না। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। ফলে তাদের দৌরাত্ম্য থাকাটাও খুব স্বাভাবিক। যদিও স্যাটেলাইট টিভিগুলোর কাছে এসব অনলাইন টিভি কিছুতেই ধোপে টেকে না। নামেই তালপুকুর, আসলে ঘটি ডোবে না। সুতরাং এত উদ্বেগের কিছু নাই। বরং এটা হাস্যকরই বটে। তবে ‘উন্মোচন’ তাদের প্রতিবেদনে যে চিত্র উন্মোচন করেছে তা কেবল কোনো একটি এলাকা অথবা রাজধানীরই নয়, সারাদেশে এই একই চিত্র বিদ্যমান। ‘উন্মোচনের’ মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা সাংবাদিকদের প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন সেটার সঙ্গেও সারাদেশের বাস্তবতায় পুরোপুরি মিল রয়েছে। অর্থাৎ ভুঁইফোড়দের বেপরোয়া তৎপরতার কারণে সচেতন মানুষজন সাংবাদিকদের এখন আর ভালো চোখে দেখছেন না। তারা পুলিশের পাশাপাশি ইদানীং সাংবাদিকদেরও নানাভাবে গালাগাল করছেন।

অন্যদিকে তথাকথিত খবরভিত্তিক অনলাইন টিভি চ্যানেলগুলোর লোভনীয় কায়-কারবার দেখে সাধারণ মানুষজনের মনে ভ্রান্ত ধারণাও জন্মেছে। তারা মনে করছেন, অনেক নামকরা টিভি চ্যানেল এগুলো। কত লম্বা সময় ধরে গ্রামের খবর প্রচার করে এসব অনলাইন টিভি। ফলে সাধারণ মানুষজন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, অনলাইন টিভিগুলোই গ্রামাঞ্চলের মানুষের কথা বলছে। স্যাটেলাইট টিভিগুলো গ্রামের মানুষের কথা বললেও তা দায়সারা। কেননা তারা সময় খুব কম দিচ্ছে। সহজ সরল সাধারণ মানুষের এমন দৃষ্টিভঙ্গিটাই কেবল উদ্বেগের। এই দৃষ্টিভঙ্গি এখনই দূর করা দরকার। তা না হলে সামনে আরো অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে।

যদিও কোনটা স্যাটেলাইট টিভি আর কোনটা অনলাইন টিভি তা বহু মানুষ বোঝেন না। গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই না বোঝার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের মানুষকে টার্গেট করেই মূলত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বাহারি সব নামের অনলাইন টিভি। আর বেশুমার অনলাইন নিউজ পোর্টালের কথা বলাই বাহুল্য। ইদানীং অনেক নাম সর্বস্ব অনলাইন পোর্টাল তাদের নামের সঙ্গে ‘টিভি’ শব্দটাও যুক্ত করে দিয়ে প্রতারণার আরেক ফাঁদ খুলে বসেছে। যেখানে একটি ভিডিও নিউজ তো দূরের কথা নিয়মিত কোনো নিউজই আপ হয় না। যাই হোক যেটা বলছিলাম, অনলাইন টিভি চ্যানেলগুলোর লোকজনের প্রায় একই আদলের ক্যামেরা ও এর তিন ঠ্যাঙ (স্ট্যান্ড) এবং তাদের হাতে তার যুক্ত ছোট আকারের একখান ‘মানানসই বাঁশ’ (বুম) দেখলেই মানুষজন খেই হারিয়ে ফেলেন। দুই টিভির পার্থক্য অনুধাবন করতে পারেন না। এ কারণে মূল ধারার স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতিনিধিদের অনেকটা ‘অস্তিত্ব সংকটে’ পড়ার উপক্রম তৈরি হয়।

অন্যদিকে অখ্যাত অনলাইন টিভি চ্যানেলগুলোর (বেশিরভাগ) লোকজনের পোয়াবারো অবস্থা দেখা যায়। যদিও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের (কিছু অখ্যাত চ্যানেল বাদে) পেশাদার প্রতিনিধিদের কাছে তারা কিছুই নন, নস্যিই বলা যায়। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, স্যাটেলাইট টিভির প্রতিনিধিদের মধ্যে অনেককেই নিজেদের টিভি সাংবাদিক হিসাবে জাহির করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হতে দেখা যায় না। কাজের মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিয়ে থাকেন। আর অনলাইন টিভি চ্যানেলের লোকজন আমজনতার সামনে নিজেদেরকে বিশাল মাপের ‘সাংবাদিক’ হিসাবে পরিচিত করে তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিছু পয়সার জন্য খবরের অযোগ্য বিষয়াদী নিয়েই তারা পড়ে থাকেন। দিনভর ছুটে বেড়ান এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়। ভাবসাব দেখে যে কারো মনে হতে পারে, তারা বোধ হয় অনেক বড় মাপের সাংবাদিক। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। ফলে সঙ্গত কারণেই তারা অনেকের কাছে প্রতারক হিসাবে চিহ্নিত।

একটি ভালো মানের স্যাটেলাইট চ্যানেল যেখানে মফস্বলের খবরে এক থেকে দেড় মিনিট সময় দিতেই হিমশিম খায় (ক্ষেত্র বিশেষে কমবেশি হয়), সেখানে মানহীন অনলাইন চ্যানেলগুলো একটি ‘খবরে’ অনায়াসেই আট-দশ মিনিট সময় বরাদ্দ দেয়। তাদের লোকজন ভুলভাল যেভাবেই স্ক্রিপ্ট পাঠান হুবহু সেভাবেই পরিবেশন করা হয়। সেইসব চ্যানেলের নিউজ প্রেজেন্টারদের ভাবভঙ্গি, রঙঢং আর অশুদ্ধ উচ্চারণ দেখে মনে হয়, তারা ঠিকমতো রিডিং পড়তেও জানেন না। যা দেখলে হাসি আটকে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়ে। কোনো কারণে কারো যদি মন খারাপ থাকে তাহলে কমেডিয়ান কিছু দেখার দরকার হবে না। কয়েকটি অনলাইন টিভির ‘খবর’ দেখে আসতে পারেন তাতেই ব্যাপক হাসির খোরাক পাওয়া যাবে।

অনেকে মনে করেন, কিছুসংখ্যক নাম সর্বস্ব অনলাইন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ মফস্বল এলাকায় মাসোহারার ভিত্তিতে লোক দিয়ে রাখেন। এ কারণে এসব লোকেরা যে ‘খবরই’ হোক আর যেভাবেই স্ক্রিপ্ট পাঠাক তা কোনো রকম কাটছাঁট ছাড়াই প্রচার করেন তারা। এরপর সেইসব ‘খবর’ ফেসবুকে শেয়ার করা হয়। হাতে হাতে থাকা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল মানুষজন না বুঝেই সেগুলোকে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের খবর হিসাবে মনে করেন। এসব মানুষের কাছে অনলাইন চ্যানেলের লোকজন ‘বিরাট সাংবাদিক’ হিসাবে ‘খ্যাতি’ অর্জন করতে সক্ষম হন। ফলে খবরের অযোগ্য ছোটখাটো বিষয়েও তাদের কাছে ডাক পড়ে এই ‘খ্যাতিমানদের’। টাকার চুক্তিতে সেইসব অনলাইন চ্যানেলে ভুলভাল কোনো রকমে তুলে আনা হয় তাদের অভিযোগ কিংবা অন্য কোনো ‘খবর’। যেখানে স্থান পায় প্রতিহিংসামূলক মনগড়া কাহিনিও। এর বাইরে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছাড়াও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নানা কৌশলে বিশেষ সখ্য গড়ে তোলেন এই ‘খ্যাতিমান’ লোকজন।

এসব ক্ষেত্রে আরেকটি মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। মফস্বল এলাকায় এ রকমের ‘বড়মাপের খ্যাতিমান সাংবাদিকদের’ একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এক গ্রুপ চুক্তি অনুযায়ী কারো ‘খবর’ প্রচারের ব্যবস্থা করে দিলেই অপর গ্রুপের গা জ্বলতে শুরু করে। তারা আবার সেই ‘খবরের’ কাউন্টার দেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। ফলে সরল টাইপের ভিক্টিমরাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাউন্টারবাজদের কুনজরে পড়ে যান। নানাভাবে নাজেহাল হন। আবার কেউ ডাকুক বা নাই ডাকুক অনেক ক্ষেত্রে নিজ গরজেই কাউন্টার গ্রুপের লোকজন ‘খবরের শিকার’ প্রতিপক্ষের কাছেও হাজির হয়ে যান। দুয়েকটি ক্ষেত্রে আবার সৌভাগ্যক্রমে তাদের ডেকেও নেয়া হয়। আর টাকার চুক্তিতে মিলে গেলেই পুরোপুরি অপেশাদারিত্বের সাথে কোনো মতে গোঁজামিল দিয়ে সম্প্রচার হতে থাকে সেই কাউন্টার গ্রুপের ‘খবরও’। এর মাধ্যমে অনলাইনগুলোর লোকেরা তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপকে ছোট করার মোক্ষম সুযোগটাও গ্রহণ করেন, আবার ভুক্তভোগী ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে পয়সাও হাতিয়ে নেন। এই চক্রের সঙ্গে অখ্যাত কিছু স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রতিনিধিরাও জড়িত থাকেন।

অপরদিকে মূল ধারার স্যাটেলাইট টিভির প্রতিনিধিদের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে মোটেও দৌড়ঝাঁপ থাকে না। তাদের কাছে যেটা খবর হিসাবে বিবেচিত হয় কেবল সেখানেই ছুঁটে যান। অফিসের দেয়া বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টও কভার করেন তারা। তবে তারাও যে শতভাগ সততা নিয়ে কাজ করেন তাও নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নাই। তবুও যতদূর সম্ভব নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রেখে চলেন এটা শতভাগ নিশ্চিত। এখন একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, স্যাটেলাইট টিভির প্রতিনিধি আর অনলাইন টিভির লোকজন বলছি কেন?। দুটোকে দুইভাবে বলার কারণ হচ্ছে, মূল ধারার স্যাটেলাইট টিভিতে প্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। পেশাদার সাংবাদিক তো বটেই শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে যাচাই বাছাই করে তবেই তাদের চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়। অন্যদিকে হাতে গোণা মাত্র কয়েকটি ছাড়া চলমান অনলাইন টিভিগুলোয় এসবের কিছুই লাগে না। যে কোনো ব্যক্তি তাদের প্রতিনিধি হতে পারেন, শুধু তাদের চাহিদামতো টাকার জোগান দিতে পারলেই চলে। সুতরাং তারা কোনো পেশাদার সাংবাদিক নন, কয়েকটি কারণের মধ্যে মূলত এ কারণেই আমার কাছে তারা ‘লোকজন’ হিসাবে বিবেচিত।

তবে আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনলাইন টিভির বিপক্ষে নই। প্রত্যাশা করি, তারা সাংবাদিকতার নামে বাণিজ্যিক বা আরেকটু খোলাসা করে বললে চাঁদাবাজির চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে এসে যোগ্য ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় সত্যিকার অর্থেই পেশাদার সাংবাদিকদের প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ করে সব মানুষের আস্থা অর্জন করুক। অবাধ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে স্যাটেলাইট টিভির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামুক এবং তারা স্যাটেলাইটকেউ ছাড়িয়ে সাফল্যের চূড়ায় উঠুক। যদিও আমার এই প্রত্যাশা হতাশায় পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনাই অনেক বেশি। এখানে একটু বলে রাখা দরকার, সাংবাদিক কমিউনিটির বাইরে অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, অামি কী অনলাইন টিভিতে সাংবাদিকতা করতে আগ্রহী, হঠাৎ এ নিয়ে বলছি কেন?। যদিও এই প্রসঙ্গটা এখানে তুলে আনার দরকার ছিল না, তারপরেও কিছু মানুষের ভুল ভাঙাতে প্রসঙ্গটা টেনে আনলাম। আসলে ১০-১১ বছর আগে একটি নামী বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু অনিবার্য কারণে তা গ্রহণ করিনি। সুতরাং এখন অনলাইন টিভিতে কাজ করার প্রশ্নই ওঠে না।

সার্বিকভাবে বর্তমান পেক্ষাপটে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে অনলাইন টিভি চ্যানেলগুলোর লোকজনের কদর তুলনামূলক বেশিই মনে হচ্ছে। এর কারণ, তারা এক-দেড় মিনিটের চেয়ে আট-দশ মিনিট ‘খবর’ পাচ্ছেন তাও আবার যখন তখন হাতের নাগালেই (মোবাইল ফোনে)। এ রকম সহজলভ্যতার কারণে সরকারি, বেসরকারি অনেক সভা-সমাবেশেও এসব লোকজন ‘গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক’ হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছেন। কারণ ওই যে বললাম, এতে এক-দেড় মিনিটের চেয়ে আট-দশ মিনিটের কভার পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে আয়োজকদের, অতিথিদের, সমবেতদের বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য একে একে সম্প্রচার করা হচ্ছে। আর প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রায় পুরোটাই সম্প্রচারে যাচ্ছে। যারা কভার হচ্ছেন তারা সোৎসাহে নিজেদের ফেসবুকে শেয়ার করছেন। একই সঙ্গে অনেককে ট্যাগও করছেন। সুতরাং তারা এতসব সুযোগ সুবিধা থাকতে এক-দেড় মিনিট কভারের জন্য স্যাটেলাইট টিভির প্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দেয়ার কোনো দরকার মনে করেন না। যদিও স্যাটেলাইটে এসব কমন সভা-সমাবেশ কভারের সুযোগ খুবই সীমিত। সে ক্ষেত্রে অনলাইন টিভি চ্যানেলগুলোরই ‘জয়জয়কার’ অবস্থা বলা যায়। যাই হোক আমার এই এলোমেলো লেখাটা সচেতন মানুষজন কীভাবে নেবেন জানি না। তবে সরল মানুষজনের কাছে কী মনে হবে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আজ আর নাই বা বলি।

❑ লেখক : এস আর সেলিম, সাংবাদিক।

সেপ্টেম্বর ০৬.২০২১ at ২১:৫০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এস/জআ