শিক্ষাঙ্গনে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দুশ্চিন্তা

প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেশের সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী টানা ১৮ মাস ঘরে বসে থাকার পর শুরু হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের পর নড়েচড়ে বসেছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। গতকাল শনিবার থেকে স্কুল-কলেজগুলোতে জোরেশোরে শুরু হয়েছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। বন্ধ থাকা ক্লাসরুম, ধুলো পড়া ব্ল্যাকবোর্ড আর প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় চলছে ঝাড়ামোছা।

তবে খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি বজায় রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে রাজধানীর পুরোনো ও বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ২৮ থেকে ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছে। রয়েছে একাধিক ক্যাম্পাস। মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেককে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে আনা হলে এসব প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে না। এ আশঙ্কা ভর করেছে অভিভাবকদের মধ্যেও।

রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজার ছাত্রী। বেইলি রোডের মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও রাজধানীর ধানমন্ডি, আজিমপুর ও বসুন্ধরায় তাদের তিনটি ক্যাম্পাস রয়েছে। খ্যাতনামা অন্য প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের রয়েছে ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। কলেজ শাখা শুধু মেয়েদের। মতিঝিলের মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও বনশ্রী ও মুগদায় তাদের দুটি শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। মিরপুরে মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৫ হাজারের কাছাকাছি। মনিপুরে মূল বালক ও মূল বালিকা শাখা ছাড়াও রূপনগর, শেওড়াপাড়া ও ইব্রাহীমপুরে তিনটি শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। ভর্তির চাপ থাকায় করোনার আগে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোতেই একাধিক সেকশন এবং প্রতিটি সেকশনে আবার ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হতো। এখন এসব প্রতিষ্ঠানে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে শিক্ষকরাই সন্দিহান।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, কোনোভাবেই গাদাগাদি বা ঠাসাঠাসি করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার সুযোগ নেই। আমরা বলে দিয়েছি, প্রতিটি বেঞ্চ ৫ ফুট দূরত্বে বসাতে হবে। আর সব শিক্ষার্থীকে একই দিনে ক্লাসে আসতে হবে না। কোন ক্লাসে কাদের কবে আসতে হবে, তা আমরা শিগগিরই জানিয়ে দেব।

মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-১) আমিনুল ইসলাম টুকু জানান, প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার খবর পাওয়ার পর শনিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা বিদ্যালয়ে জোরেশোরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করেছেন।

মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ হাফিজুল ইসলাম সমকালকে জানান, প্রতিষ্ঠান আগেই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা ছিল। নতুন করে আবারও তা করা হচ্ছে। তার প্রতিষ্ঠানে কলেজ শাখা পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাদের পরিকল্পনা, একটি শ্রেণিকক্ষে ২০ জনের বেশি বসাবেন না।

ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সাবিনা ইয়াসমিন জানান, পুরো বিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিস্কার করা হচ্ছে। তারা ছাত্রদের আসার অপেক্ষায় থাকবেন। খুশি শিক্ষকরাও। তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাজেদুল আলম বলেন, ছাত্রীদের পদচারণায় আবার বিদ্যালয়ের আঙিনা মুখর হবে, আমরা আবার ক্লাসরুমে পাঠদানে ফিরে যেতে পারব ভেবে ভালো লাগছে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলার প্রস্তুতিতে আমরা খুশি। তবে খোলার পর যেন স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি প্রতিপালিত হয়।

আজ আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার বিষয়ে আজ রোববার বিকেল ৩টায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এতে সভাপতিত্ব করবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষা-সংশ্নিষ্টরা সভায় অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হবে। খুলে দেওয়ার পর রিকভারি প্ল্যান নির্ধারণ করা হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে থেকে খোলা হবে, কীভাবে চলবে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্কুল-কলেজ খোলার পর কী কী করণীয়, সেসব বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সচিব বলেন, দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে গেছে। সেই ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে আমরা কিছু পরিকল্পনা তৈরি করেছি। এসব পরিকল্পনা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হবে। এ জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের একটি সার্বিক চিত্র সংবলিত প্রতিবেদন শিক্ষা বোর্ডে পাঠাতে হবে। মাউশি ও বোর্ড কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন মনিটর করবেন। শিক্ষা খাতের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, করোনার সংক্রমণ হার যেহেতু এখনও ১০ শতাংশ, তাই হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই।

প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর আসবে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা এবং তা বাস্তবায়ন। গতকাল শনিবার চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ঘাটতি হয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ইমারজেন্সি কেয়ার উদ্বোধনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, করোনা মহামারির প্রকোপ কমতে থাকায় সশরীরে স্কুল-কলেজে ক্লাস চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্কুল-কলেজ খোলার পর প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে একদিন ক্লাস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আপাতত এটিই আমাদের পরিকল্পনা। তবে সেটা পরিবর্তন হতে পারে।

প্রাথমিকের রিকভারি প্ল্যান সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম শনিবার সমকালকে বলেন, আগে বিদ্যালয় খোলার বিষয়টি চূড়ান্ত করি। এরপর এ বছরের বার্ষিক পরীক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর কী হবে, সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

মাউশির নির্দেশনা: সারাদেশের স্কুল-কলেজ প্রধানদের কাছে পাঠানো নির্দেশনায় মাউশির গাইডলাইনে বলা হয়, তিন ফুট দূরত্বে শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চগুলোকে বসাতে হবে। পাঁচ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের বেঞ্চে একজন শিক্ষার্থী এবং পাঁচ থেকে সাত ফুট দৈর্ঘ্যের বেঞ্চে দুই শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস করতে পারবে। স্কুলে ঢোকার আগেই থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করার কথাও বলা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর: প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পাঠানো নির্দেশনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বলা হয়েছে, স্কুল খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালিত হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুখে মাস্ক পরা, হাত পরিস্কার, থার্মোমিটার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে।

পরিকল্পনার রয়েছে, স্কুলের গেটে বা প্রবেশের স্থানে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও পানির ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করবেন। থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে প্রবেশ করানো হবে। আগের মতো ক্লাসে এক বেঞ্চে তিন বা চারজন শিক্ষার্থী বসতে পারবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এক বেঞ্চে দুই শিক্ষার্থীকে বসাতে হবে।

আরো পড়ুন :
চৌগাছা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ওয়ার্ড কমিটি গঠনের জন্য প্রস্তুতি সভা
পিরোজপুর বাজারে ৩ কেজি ওজনের ইলিশ

প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আগের মতো আর সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস হবে না। কবে কোন বিষয়ের ক্লাস হবে, তা শিক্ষক ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির (এসএমসি) সদস্যরা বসে নির্ধারণ করবেন। একটি স্তরে সপ্তাহে দুই বা তিন দিন অথবা প্রতিদিন দুই-তিনটি ক্লাস নেওয়া হবে। তবে ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে চতুর্থ শ্রেণিকে অধিক গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।

সেপ্টেম্বর  ০৫.২০২১ at ১১:১৫:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/সম/রারি