সিনহা হত্যা: দ্বিতীয় দফা সাক্ষ্যগ্রহণ

আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকার্যের দ্বিতীয় দফা সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে রোববার (৫ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে দ্বিতীয় পর্যায়ের এ সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা।

জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বিষয়টি জানান।

তিনি জানান, গত ২৩ আগস্ট শুরু হয়েছে মেজর সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম। সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম তিনদিনের প্রথম দিন ও দ্বিতীয় দিনের অর্ধেক সময় মামলার বাদী নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য ও জেরা নেয়া হয়। পরে শুরু হয় সিনহার সফরসঙ্গী ও হত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী সিফাতের সাক্ষ্যগ্রহণ। এ দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করতেই প্রথম নির্ধারিত তিন দিন শেষ হওয়ায় বাকি ১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি আরও জানান, গত ২৫ আগস্ট ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারদিন পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করেন আদালত। এ মামলায় মোট সাক্ষী ৮৩ জন। সাক্ষ্য ও জেরার সময় ১৫ আসামিকে কাঠগড়ায় উপস্থিত রাখা হবে।

এদিকে প্রথম দুই সাক্ষীর জবানবন্দিতে সিনহা হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন সাক্ষ্যগ্রহণে অংশ নেয়া আইনজীবীরা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সিফাত আদালতকে বলেন, ‘সেদিন রাতে (৩১ জুলাই, ২০২০) পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে রাস্তায় ঢলে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন সিনহা মো. রাশেদ খান। টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমে লিয়াকত আলীর সঙ্গে আড়ালে গিয়ে কথা বলেন। এরপর সিনহার কাছে গিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে আপত্তিকর ভাষায় গালমন্দ করেন। পরে তিনি নিজের পা দিয়ে সিনহার শরীর নড়াচড়া করে দেখেন। তখনো সিনহা জীবিত ছিলেন এবং ‘পানি পানি’ করছিলেন। তখন ওসি প্রদীপ সিনহার বুকে লাথি মারেন এবং পা দিয়ে গলা চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। তল্লাশিচৌকির ভেতরে নিয়ে তাকেও মারধর করেন প্রদীপ।’

বাদী শারমিন ফেরদৌস আদালতকে বলেন, ফোনে পরিদর্শক লিয়াকত বলেছে ‘টার্গেট ফেলে দিয়েছি, তোরা তাড়াতাড়ি আয়।’ আরেক ফোনে তিনি বলেন, ‘স্যার একটাকে ডাউন করেছি, আরেকটারে ধরে ফেলেছি।’ সিনহা পানি ও শ্বাস নিতে চাইলে লিয়াকত গালাগাল করে কোমরে লাথি মেরে ফেলে দেন এবং মাথা চেপে ধরেন। এরপর পুলিশ এলে লিয়াকত নির্দেশ দেন আশপাশের মানুষকে ভয় দেখাতে, যাতে কেউ সিনহাকে সাহায্য করতে না পারে, ছবি বা ভিডিও করতে না পারে। আমার ভাইকে হত্যা করার পর ইন্সপেক্টর লিয়াকতের কথোপকথনের একটি অডিওতে বিশ্ববাসী এসব কথোপকথন শুনেছেন। আমি ওসি প্রদীপ-লিয়াকতসহ জড়িতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। তাঁর সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম।

অভিযুক্ত আসামিদের মাঝে পুলিশের ৯ সদস্যরা হলেন-বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেব নাথ।

অপর আসামিরা হলেন-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

কারাগারে থাকা আসামিদের ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়েছিলো।

সেপ্টেম্বর ০৫.২০২১ at ১০:০৯:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/জানি/জআ