দখল চলছেই, উদ্ধার গতিহীন

বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধারে ৩ মাসের মধ্যে বহুতল ভবন, বাজার, কল-কারখানাসহ ৭৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কথা ছিল। তবে গত ৫ মাসে ১০টি টিনশেড ঘর উচ্ছেদ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ৭ বছর ধরে চিঠি চালাচালি, কমিটি গঠন আর কয়েক দফা সরজমিন পরিদর্শনের মধ্যেই সীমিত রয়েছে সব।

প্রতিদিনই আবর্জনা ফেলে এ চ্যানেলটি ভরাট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে খোদ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে। বিতর্ক রয়েছে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের করা স্থাপনার তালিকা নিয়েও।

পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের কিছুটা পশ্চিমে কামরাঙ্গীরচরকে মধ্যে রেখে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। চার দশক আগেও এর উত্তর দিকের শাখাটি লালবাগ কেল্লার কাছ দিয়ে নবাবগঞ্জ, হাজারিবাগ হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিলিত ছিল। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে কল-কারখানা, বহুতল ভবন, মার্কেট, বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্য স্থাপনা।

দক্ষিণ দিকে মূল বুড়িগঙ্গা প্রবাহমান। অন্যদিকে, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে কেরানীগঞ্জের ভেতর দিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে সংযুক্ত ছিল বুড়িগঙ্গা। এখন সেটিও বন্ধ। বন্ধ হয়ে যাওয়া এই দুই চ্যানেলকেই প্রচলিতভাবে আদি চ্যানেল বা খাঁড়ি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ঢাকার চারপাশের নদনদী রক্ষায় ২০০৯ সালে করা রিটের ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধারেরও নির্দেশনা চায় হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। ওই আবেদনের শুনানিতে ১২ অক্টোবর উচ্চ আদালত হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় সিএস/আরএস ম্যাপ অনুযায়ী আদি চ্যানেলের সীমানা চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন।

এরপর ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর ৭৪টি স্থাপনাকে অবৈধ চিহ্নিত করে আদালতে তালিকা জমা দেয়। গত ১৮ মার্চ বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ ৩ মাসের মধ্যে ওইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেন।

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ জানান, নির্দেশনা অনুসারে পদক্ষেপ নিয়ে ২৬ জুনের মধ্যে ঢাকার জেলা প্রশাসক ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে পরিপূর্ণ উচ্ছেদের কথা বলা হয়নি। তারা কিছুটা উচ্ছেদ করেছেন জানিয়ে আদালতের কাছে সময় চেয়েছেন। এ বিষয়ে এখনো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।

এদিকে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল উদ্ধারের নামে গত ১৫ জুন মাত্র কয়েক ঘণ্টার উচ্ছেদ অভিযান চালাতে দেখা যায় ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএকে। তখন কামরাঙ্গীরচরের লোহারপুল এলাকা থেকে ব্যাটারি ঘাট পর্যন্ত ১০টি ছোটখাট স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর সেখানে সীমানা পিলার স্থাপন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এরপর আর উচ্ছেদ কার্যক্রম দেখা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক গুলজার আলী জানান, বন্দর সীমানার বাইরে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর এখতিয়ার আমাদের নেই। কামরাঙ্গীর চর ও হাজারীবাগের ওই অংশ বিআইডব্লিউটিএর আওতার বাইরে। আদি চ্যানেল রক্ষার অভিযানটি মূলত পরিচালিত হবে জেলা প্রশাসনের অধীনে। যখন জেলা প্রশাসন আমাদের কাছে এক্সকাভেটর, লোকবলসহ অন্যান্য সহায়তা চাইবে, আমরা দিব। কিন্তু উচ্ছেদের প্রোগ্রামটা তাদেরই করতে হবে।

আদি চ্যানেলে অবৈধ ৭৪ স্থাপনার যে তালিকা উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়েছে, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয় চ্যানেলটিতে পানিপ্রবাহ না থাকার কথা। ৬০, ৬৪ ও ৬৫ পৃষ্ঠায় বলায় হয়, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর সংলগ্ন চ্যানেলের (আদি বুড়িগঙ্গার-২য় চ্যানেল) অধিকাংশ জমি অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে এবং ‘কয়েক হাজার’ স্থাপনা ও বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। নদীর জায়গায় ম্যাটাডোর পার্ক, পান্না গ্রুপের কারখানা, হাসপাতাল ও সুগন্ধা কৃষি মার্কেট তৈরির কথাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, আদি চ্যানেলের যে ব্যাপ্তি, তাতে মাত্র ৭৪টি স্থাপনা অবৈধ হবে- এটা যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয়, এখানে দখলদারদের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো দখলের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘আংশিক’। ফলে কোন স্থাপনার কতটুকু অংশ অবৈধ সেটা উল্লেখ করা হয়নি। অনেকটা দায়সারা গোছের তালিকা। এভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালালে বিতর্ক বাড়বে। তিনি সঠিক তালিকা করে দ্রুত নদীর আদি চ্যানেল উদ্ধার ও পানিপ্রবাহ নিশ্চিতের দাবি জানান।

২০১৪ সালের ২৫ মে নদীরক্ষাসংক্রান্ত তৎকালীন টাস্কফোর্সের সভাপতি ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খান কয়েকজন মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে আদি চ্যানেল পরিদর্শনে যান। চ্যানেলটির দুরবস্থা দেখে নৌমন্ত্রী পর দিনই সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠকে আদি চ্যানেল উদ্ধারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও ৭ বছরেও সেসব বাস্তবায়ন করা হয়নি।

সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এখনো এই চ্যানেলের বিভিন্ন অংশে দখল তৎপরতা চলছে। কেল্লারমোড় শ্মশানঘাট এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে নদীর অংশে গড়ে তোলা হয়েছে রিকশা ভ্যানের গ্যারেজ। প্রতিদিনই আবর্জনা ফেলে একটু একটু করে ভরাট করা হচ্ছে। খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ভ্যানগুলোকে সেখানে আবর্জনা ফেলতে দেখা গেছে। ইসলামবাগে মদিনা ফিলিং স্টেশনের বিপরীতেও দেখা গেছে কয়েক’শ ফুট মাটি ভরাটের চিত্র। সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট।

কামরাঙ্গীরচরের লোহারপুলের নিচে মাটি ও ময়লা আবর্জনা ফেলে দুপাশ ভরাট করা হয়েছে। অসংখ্য বাড়িঘর, বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে সেখানে। সেতুর পশ্চিম দিকে কিছু দূর যাওয়ার পর চ্যানেলটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে আড়াআড়িভাবে একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পান্না গ্রুপের ভলবো ব্যাটারির কারখানায় যাওয়ার জন্য সেটি করা হয়েছে বলে জানা যায়। গ্রুপটি আদি চ্যানেলের জায়গায় বিশাল কারখানা তৈরি করেছে।

২০০৩ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণ করা নবাবগঞ্জের পাকা সেতুটির নিচে দেখা গেছে, পানি নেই, আছে মাটি। আবাসন ব্যবসায়ীরা বালু ভরাট করে ওই এলাকায় সারি সারি প্লট তৈরি করেছেন। একই অবস্থা কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুর ও হাজারীবাগের কোম্পানিঘাট সেতুরও। কামরাঙ্গীরচরে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) সাব স্টেশনটিও তৈরি হয়েছে এ আদি চ্যানেল ভরাট করে। হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাস ও এর আশপাশের এলাকার দখল দেখে বোঝার উপায় নেই, কোনোদিন এখানে পানির প্রবাহ ছিল।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে গঙ্গার একটি প্রবাহ ধলেশ্বরী নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ত। এই ধারাটি গতিপথ পরিবর্তন করে এক সময় গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বুড়িগঙ্গা নামে অভিহিত হয়। ১৮৯৭ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে ঢাকার উজানের দিকের নদনদীগুলো টাইঙ্গাইলের পরে মধুপুর জঙ্গলের উত্তর থেকে কিছুটা দক্ষিণে সরে যায়। সে সময় (মতভেদে তারও আগে ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পে) সলমাসি, কলাতিয়া, মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ এলাকা দিয়ে প্রবাহমান বুড়িগঙ্গাও দক্ষিণে সরে আসে। তখন তলদেশের গঠনগত পরিবর্তন হওয়ায় নদীতে পলি পড়ার গতিও বেড়ে যায়।

আরো পড়ুন :
জাগ্রত তারুণ্য’ ঢাকা মহানগর কমিটির বর্ষপূর্তি
১২ সেপ্টেম্বর ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

মাঝখানে জেগে উঠতে থাকে চর, যার একটি অংশ পরবর্তী সময়ে কামরাঙ্গীর চর ও আরেকটি অংশ নবাবেরচর হিসেবে পরিচিত হয়। এসব চরের ভেতর দিয়ে কয়েকটি খাল ও জলাভূমি থাকার প্রমাণ দেখা যায় উনিশ শতকের শুরুর দিকে প্রণীত সিএস ম্যাপে।

সেপ্টেম্বর  ০৫.২০২১ at ০৯:৩৮:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভোকা/রারি