এক টুকরো খবর মেলেনি পত্রিকায়!

এস আর সেলিম

অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে একই ধরনের বিষয় নিয়ে আবারো এই ‘আবল তাবল’ লেখার সুযোগ সৃষ্টি হলো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠ সৈনিক, কালজয়ী সংগীত শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বারের পর এবার ‘উপেক্ষিত’ হয়েছেন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের রূপকার, এলজিইডির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী, সা‌বেক স‌চিব, মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। আজ (১ সেপ্টেম্বর) ছিল কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। দুদিন আগে (৩০ আগস্ট) ছিল আব্দুল জব্বারের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। দেশবরেণ্য এই দুই ব্যক্তির বাড়ি কুষ্টিয়ায়। অথচ এখানকার পত্রিকায় তাঁদের মৃত্যুবার্ষিকীতে এক টুকরো খবরও মেলেনি। যদিও দুজন দুই অঙ্গনের মানুষ। তাদের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রেও অন্য রকম ফারাক রয়েছে। আব্দুল জব্বার সারাদেশে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। ছিলেন একজন কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী। সেই তুলনায় নিভৃতচারী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের পরিচিতির পরিধি খুব একটা বিস্তৃত না হলেও তিনি নিজেই ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠান। তাঁরা দুজনই দেশের জন্য বিশেষ অবদান রেখে গেছেন।

গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কুষ্টিয়া থেকে অনেকগুলো (সঠিক সংখ্যার হিসাবে নানা মত আছে) পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যাই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নানা কারণেই ঐতিহ্য বহন করে আসা এই কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশ হওয়া সংবাদপত্রে জেলার গৌরব বয়ে আনা কৃতিসন্তানদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অন্তত এক টুকরো খবর থাকাটাই সবার কাম্য। এড়িয়ে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। গুণীজনদের প্রয়াণ দিবসে পত্রিকাগুলো তাঁদের একটু স্মরণ করলে সমস্যা কোথায় তা বোধগম্য নয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাঁদের মৃত্যুবার্ষিকীর খবর পত্রিকার পাতায় তুলতেই হবে এটা কী জরুরি কিছু?। না ঠিক জরুরি বলবো না। তবে নিজ জেলার পত্রিকায় তাঁদের স্মরণ করাটাও দোষের কিছু নয়। বরং এর মাধ্যমে তাঁদের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। আর পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরে বিশেষ দিনে সাধারণ মানুষজনও তাঁদের জন্য একটু দোয়া করার সুযোগ পান।

কামরুল ইসলাম সিদ্দিক যখন জীবিত ছিলেন তখন তাঁকে নিয়ে কতই না খবর, প্রতিবেদন, ফিচার পত্রিকাগুলোয় দেখা গেছে। যার কোনো হিসাব নাই। আর মৃত্যুর পর বছরে একবার স্মরণ করতেও পত্রিকাগুলো ‘কার্পণ্যতা’ দেখাচ্ছে। তাহলে কী তিনি জীবিত থাকতে সরকারি বিজ্ঞাপন বা বিশেষ কোনো সুবিধাপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতা ছিল?। তবে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন আরটিভিই কেবল প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর খবরটা ফলাও করে প্রচার করে আসছে। তারা একই সঙ্গে রাখছে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনী নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। অন্যদিকে স্থানীয় গণমাধ্যমের উদাসীনতা দৃশ্যমান হয়ে উঠলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঠিকই এই গুণী ব্যক্তিদের স্মরণ করা হচ্ছে। তুলে ধরা হচ্ছে তাঁদের বর্ণাঢ্য জীবন কথা। কারণ যেটাই হোক এ ব্যাপারে গণমাধ্যম নীরব থাকলেও সেই নীরবতা ভাঙতে সক্ষম হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমই।

তথ্য ঘেঁটে পাওয়া যায়, বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে আধুনিক দেশ গড়ার অন্যতম স্থপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিক একাধারে প্রকৌশলী, নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনাবিদ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। তারই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল আজকের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তিনি একাধিক মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ক‌য়েক‌টি সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের (আইইবি) সভাপতি, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৩-০৪ মেয়াদে গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশীপের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রথম চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

বরেণ্য প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক।

দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ অবকাঠমো উন্নয়নের ইতিহাসে এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্র‌তি‌ষ্ঠিত করা ছিল তার সবচেয়ে বড় কীর্তি। তিনি এলজিইডিতে যে বীজ বপন করেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই দেশে আজ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য যে হাউজিং প্রকল্প সেটি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকেরই অবদান। আজকের পূর্বাচলেও তার বিশেষ অবদান রয়েছে। জীবদ্দশায় কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি তিনি। এলজিইডি, প্রাইভেটাইজেশন, আরবান ট্রান্সপোর্ট, পিডিবিসহ সবখানে মেধার স্বাক্ষর রেখে গেছেন বরেণ্য এই প্রকৌশলী।

কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৬৬ সালে বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর জীবন গড়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর দেশগড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন নিবেদিতপ্রাণ এই কর্মবীর।

তিনি ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্লানিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্বের উন্নত দেশ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করার মহাপরিকল্পনা ছিল তার। ছিল আধুনিক নগর কাঠামো গড়ে তোলার স্বপ্ন। তিনি কেবল স্বপ্নদ্রষ্ট্রাই ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কারিগরও। কিন্তু মৃত্যুর কাছে হেরে যাওয়ায় তার অনেক পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। দেশের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসার জন্য আমৃত্যু সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন প্রচার বিমুখ এই গুণী প্রকৌশলী। এলজিইডিতে নিরলস পরিশ্রমের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন অবকাঠামো উন্নয়নের প্রবাদপুরুষ। তিনি ২০০৫ সালে প্রায় চার দশকের কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

সুদক্ষ ব্যবস্থাপক ও উদ্ভাবনী চিন্তায় পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরুপ অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্বব্যাংক ১৯৯৯ সালে কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে ইন্টারন্যাশনাল রোড ফেডারেশন কর্তৃক বর্ষসেরা ব্যক্তি ঘোষণা করেন। ২০০৮ সালের আজকের এই দিনে ৬৩ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে ছেলের বাসায় হার্টঅ্যাটাক করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নিজ জেলার সংবাদপত্র তাকে স্মরণ না করলেও কুৃষ্টিয়াসহ সারাদেশে এলজিইডির উদ্যোগে প্রতিবছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণসভা ও বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
❑ লেখক : এস আর সেলিম, সাংবাদিক।

সেপ্টেম্বর ০১.২০২১ at ২০:৪০:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এস/জআ