অহরহ দুর্ঘটনায় যাচ্ছে প্রাণ, সঠিক দেখভাল নেই

নানা উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর সরকারিভাবে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করা হলেও কার্যত এখনো নিরাপদ হয়নি দেশের নৌপথ। বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুক্রবার (২৭ আগস্ট) ২২ জন ট্রলারযাত্রী মৃত্যুর পর আবারও বিষয়টি সামনে এসেছে। এর আগে চলতি বছরের ৪ এপ্রিল শীতলক্ষ্যায় কার্গোর ধাক্কায় সাবিত আল হাসান লঞ্চের ৩৫ যাত্রী ও ৩ মে পদ্মায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় মারা যান ২৬ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৌপথে সঠিক নজরদারির অভাব ও যুগোপযোগী আইন না থাকায় এ জাতীয় দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না।

বিআইডব্লিউটিএর তথ্য মতে, গত ১০ বছরে ২৫টি দুর্ঘটনায় ৪৪৫ লঞ্চযাত্রীর মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে ৪১০ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশীয় নৌযান ও হাওর-বাঁওড় অঞ্চলের ট্রলার ডুবির তথ্য নেই তাদের কাছে। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ জাতীয় নৌ দুর্ঘটনায় ১ হাজারের কাছাকাছি যাত্রী প্রাণ হারান বলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সূত্রে জানা গেছে। শুধু ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭০০ জনের বেশি।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জারি করা সবশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, কোনো নৌযানের দৈর্ঘ্য ২০ মিটারের বেশি হলেই সেটিকে সার্ভে সনদ নিতে হবে। এছাড়া ১২ জনের বেশি যাত্রী পরিবহনকারী বা ১৬ হর্স পাওয়ারের বেশি শক্তির ইঞ্জিনচালিত নৌযানের জন্যও সার্ভে সনদ বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে দেশে এমন কয়েক লাখ নৌযান রয়েছে- যেগুলো কোনো ধরনের নিবন্ধন, সার্ভে ও রুট পারমিট ছাড়াই চলছে অবাধে। দেশে অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা কত- এমন কোনো পরিসংখ্যানও নেই কারো কাছে। ২০১৬ সালে নৌযান শুমারির উদ্যোগ নেয়া হলেও এ সংস্থার সেই প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এসবের মধ্যে বালুবাহী জাহাজ (বাল্কহেড), ট্রলার ও স্পিডবোট রয়েছে। নৌপরিবহন অধিপ্তরের তথ্য মতে, দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা মাত্র ১৪ হাজারের মতো। বাকিগুলো নৌপুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নৌপরিবহন অধিদপ্তর বা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলছে।

এ প্রসঙ্গে লঞ্চ মালিক গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, দেশের নৌপথকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে ফেলেছে নিবন্ধনহীন বাল্কহেডগুলো। এদের রাতে চলাচলের নিয়ম নেই। তবুও তারা দিনে-রাতে সমানভাবে চলছে। এসব নৌযানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাতি নেই। বালি পরিপূর্ণ অবস্থায় নৌযানের শুধু সামনের কিছু অংশ ও পেছনের অংশ পানির উপরে থাকে।

তাই অন্য নৌযানের চালক সেটি সহজে দেখতে পান না। এ কারণে বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে চলা এসব বাল্কহেডের বিরুদ্ধে কিছু বললেই লঞ্চ মালিকদের হেনস্থা করা হয়। তিনি নৌপথে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন ও নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান।

অন্যদিকে, প্রচলিত আইনে অসামঞ্জস্যতা ও শাস্তির বিধান কম থাকায় দুর্ঘটনা কমছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ খাতের বিশ্লেষক ক্যাপ্টেন (অব.) মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, নৌ-দুর্ঘটনার জন্য মালিক ও চালক- দুই পক্ষই দায়ী হতে পারে। কারণ নৌযান চালকের ভুলে যেমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তেমনি নৌযানের ত্রুটির কারণেও সেটি হতে পারে। সঠিকভাবে নৌযান তৈরি, প্রয়োজনীয় নিবন্ধন নেয়া, নিরাপত্তা সামগ্রী নিশ্চিত করা; এমনকি সঠিক চালক নিয়োগও মালিকের ওপর বর্তায়। তিনি বলেন, কিন্তু আমরা দেখেছি, মালিক ও শ্রমিকদের চাপের মুখে গত কয়েক বছরেও অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ সংশোধন হয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আইনে রূপ নেয়নি। এসব সংগঠনের অনুরোধে বারবার তাদের মতামত নেয়ার নামে সময়ক্ষেপণ করা হয়। শুধু তাই নয়, আইনে বারবার সাজা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও তা থেকে সরে আসা হয়। ২০১৯ সালে নৌ-দুর্ঘটনার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের বিধান রাখা হলেও চাপের মুখে তা আবার ৫ বছর করে খসড়া তৈরি করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

প্রতি বছর ৪ মে নৌ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। তাদের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট যাত্রী সংখ্যার ৩৫ শতাংশ নৌপথে চলাচল করে। মোট পণ্যের ৭০ ও তেলজাত দ্রব্যের ৯০ শতাংশ নৌপথে পরিবহন করা হয়। অন্য একটি হিসাব থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৯ কোটি মানুষ দেশের নৌপথে যাতায়াত করে। নানা যৌক্তিক কারণেই নৌপথ জনপ্রিয়, সহজলভ্য এবং আরামদায়ক। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা যায়, ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ মুখোমুখি সংঘর্ষ। অতিরিক্ত বোঝাইয়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া ঝড়ের কবলে পড়ে হচ্ছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বাকি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে নৌযানের নকশা ও ইঞ্চিনের ত্রুটিসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে।

আরো পড়ুন:
আগুনে পুঁড়েছে চার ভাইয়ের বসতঘর
নেত্রকোণায় কলেজ ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির গবেষণায় দেখা গেছে, হাওর অঞ্চলের নদী ও অন্যান্য জলপথে চলাচলকারী নৌযানগুলোর বেশির ভাগই শ্যালো ইঞ্চিন বিশিষ্ট দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি। এগুলোতে দিকনির্দেশক যন্ত্র, রাতে চলাচলের মতো হেডলাইট, সিগন্যাল বাতি, মানসম্মত কাঠামো, ধারণক্ষমতা ও সময়ানুপাত জ্ঞান, যাত্রীদের নিরাপত্তা সামগ্রী, স্টিয়ারিং, ব্রেক, প্রশিক্ষিত সারেং প্রভৃতি নেই। এগুলো স্থানীয়ভাবে অতিরিক্ত যাত্রী ও মালপত্র বোঝাই করে চলাচল করে। যে কারণে একটু এদিক-সেদিক হলেই দুর্ঘটনা ঘটে।

এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা আমাদের নতুন করে বুঝিয়ে দিল, দেশীয় নৌযানগুলোকেও নিবন্ধন ও রুট পারমিটের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, আমরা অনেক দিন ধরেই এ চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু নৌযান মালিকরা তাতে সাড়া দিচ্ছেন না। যদি সেগুলো নিবন্ধন করা হয়, তবে অবশ্যই কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হবে। তখন মনিটরিং করাও সহজ হবে। এখন স্থানীয় প্রশাসন হয়তো এগুলো চলাচলের অনুমতি দেয়। কিন্তু তারা তো আর এর কারিগরি বা নিরাপত্তার বিষয়গুলো বোঝে না। তাই শৃঙ্খলা আনতে হলে নিবন্ধনের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আগস্ট ২৯.২০২১ at ১০:২৩:০০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/ভক/জআ