যশোরে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ, জেলাব্যাপি লকডাউন ঘোষণা

উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সংক্রমণ-মৃত্যুর সংখ্যা

যশোরে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা। আতঙ্কে দিন কাটছে যশোরবাসীর। এর থেকে রক্ষার জন্য দিনরাত কাজ করে চলেছে জেলা প্রশাসন। ২৩ জুন বুধবার ভোর ৬টা থেকে ২৯ জুন রাত ১২ টা পর্যন্ত যশোর জেলা সর্বাত্নক লকডাউন কার্যকরের গণবিজ্ঞপ্তি জারী করা হয় মঙ্গলবার। এর আগে তিন পর্বে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরোপতি বিধিনিষেধে অনুযায়ী জেলা প্রশাসন তিনটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন।

যশোর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের মঙ্গলবারের তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় ৫২৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৫৩ জন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্তের হার ৪৮ শতাংশ। এদিন মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে ছয়জন করোনা রোগী এবং অপর চারজন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ২, ঝিকরগাছায় ১, অভয়নগরে ১, চৌগাছায় ১ ও মণিরামপুরে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। এছাড়া যশোর জেনারেল হাসপাতালে করোনা উপসর্গ ছিলো এমন চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান বলেন, উচ্চঝুঁকির কারণে যশোরের পাঁচ পৌরসভা ও ৯ ইউনিয়নে সরকারি বিধিনিষেধ সম্প্রসারণ করা হয়। বিধিনিষেধ না মানায় শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সংক্রমণ রুখতে এবার যশোর জেলায় সর্বাতœক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।

রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো দেশে ধারাবাহিকভাবে চার সপ্তাহ করোনার সংক্রমণ পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলে গণ্য হয়। কিন্তু বর্তমানে সারাদেশে করোনার সংক্রমণ সর্বনিম্ন তিন থেকে আটগুণ বেশি। এরমধ্যে যশোরে আরও বেশি।

যশোরে ২১ জুনের হিসাবে গত ১৫ দিনে ২২৭৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। গড়ে শনাক্তের হার প্রায় ৪৫ ভাগ। গত পাঁচ জুনের আগে ১৫ দিনে শনাক্তের হার ছিল ২২ শতাংশ। এসময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৭ জন। আর মারা গেছেন ২৯ জন। এছাড়াও ভারত ফেরত যাত্রীদের মধ্যে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে টেস্ট করে এ পর্যন্ত ৬৬ জন করোনা পজিটিভ হয়েছেন।

সূত্রমতে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যেই করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত দুই মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু অন্যান্য বিভাগেও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ মারাত্মক রূপ নেয়ার পর এসব জেলায় মৃত্যুও বাড়ছে। এরমধ্যে যশোর উল্লেখযোগ্য। সংক্রমণ ও মৃত্যুর বৃদ্ধির পেছনে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে দায়ী করা হচ্ছে। ইতঃপূর্বে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে স্থানীয় উদ্যোগে আইসিইউ ইউনিটে তিনটি ভেন্টিলেটর বসানো হয়। আবারও স্থানীয়দের সহায়তায় হাসপাতালে পাঁচটি ভেন্টিলেটর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। যার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। খুব দ্রুতই চালু করা হবে এ পাঁচটি আইসিইউ বলে জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মোহাম্মদ সায়েমুজ্জামান।

তিনি আরো জানান, যশোর জেলায় গত ১৫ দিনে ২২৭৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। শেষ ১৫ দিনে গড়ে শনাক্তের হার প্রায় ৪৫ ভাগ। গত পাঁচ জুনের আগে ১৫ দিনে শনাক্তের হার ছিল ২২ শতাংশ। গত ১৫ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৭ জন। গত পনের দিনে মারা গেছে ২৯ জন। এছাড়াও ভারত ফেরতযাত্রীদের মধ্যে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে টেস্ট করে এ পর্যন্ত ৬৬ জন করোনা পজিটিভ হয়েছেন। তাদের বাধ্যতামূলক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা শেষে অবমুক্ত করা হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, যশোরের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে কোভিড রোগীদের ৮০ শয্যার রেড জোনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রেড জোনে ৮০ শয্যার বিপরীতে বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ৯২ জন। উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রোগীদের জন্য ইয়েলো জোনে ২২ শয্যা রয়েছে। এখানে ২২ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রয়েছেন ৪৫ জন। রেড জোন ও ইয়োলো জোন মিলিয়ে ১০২টি শয্যার বিপরীতে ১৩৭ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বর্তমানে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ৯ জন ডিউটি ডাক্তার ও ৪ জন কনসালটেন্ট রয়েছেন। ২০ জন নার্স রয়েছেন।

তিনি আরো জানান, এ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। দুই এক দিনের মধ্যে গ্যাস রিফিল করে চালু করা হবে। হাসপাতালে এ মুহূর্তে প্রতিটি সিলিন্ডারে ৬৮০০ লিটার অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতার ৪৮টি সিলিন্ডার মজুদ আছে। হাসপাতালে তিনটি ভেন্টিলেটর চালু রয়েছে।

যশোর জেলার করোনার বর্তমান পরিস্থিতি উত্তোরণে গৃহীত ব্যবস্থা হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্য বেসরকারি সংস্থা সাজেদা ফাউন্ডেশনের সাথে চুক্তি করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের ১০ জন চিকিৎসক, ১২ জন স্টাফ নার্সসহ আরো ২৭ জন স্টাফ হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন। সাজেদা ফাউন্ডেশন প্রতিটি সিলিন্ডারে ৭ হাজার লিটার অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতার ১০০টি সিলিন্ডার সরবরাহ করছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালে ফিমেল পেয়িং ওয়ার্ড ও এইচডিইউ ইউনিটকে রেড জোনের আওতাভুক্ত করে ৫০টি শয্যা বাড়ানো হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, স্থানীয় উদ্যোগে আইসিইউ ইউনিটের আরো ৫টি ভেন্টিলেটর শিগরিগরই চালু করা প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ভারত ফেরত যাত্রীদের মধ্যে কোয়ারেন্টিন শেষে শনাক্তকৃত উপসর্গবিহীন করোনা রোগীদের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার জন্য জনতা হাসপাতাল নামের একটি প্রাইভেট ক্লিনিক প্রস্তুত করা হয়েছে। এ হাসপাতালে ৩০ জনকে রেখে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে।

তিনি আরো জানান, সংক্রমণ প্রতিরোধে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটি নিয়মিত সভা করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

তিনি আরো জানান, সরকার আরোপিত বিগত ২৯ মার্চ ২০২১ তারিখে ঘোষিত লক ডাউন ও সার্বিক কার্যাবলী/ চলাচলে বাধা নিষেধ আরোপের পর থেকে যশোর জেলায় স্বাস্থ্য বিধি প্রতিপালন না করাসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৪৯৩ টি মামলায় ১৪ লাখ দুই হাজার ৮৮০ টাকা জরিমানা ও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।